মার্চ ০৭, ২০২২ ১৭:৪০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি। আজ আমরা ইরাকের ফাও উপত্যকা, শালামচে অঞ্চল ও মাজনুন দ্বীপপুঞ্জ ইরানের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং আমেরিকার গুলিতে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করব।

১৯৮৮ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধ সমাপ্তির তিন মাস আগে ইরাকের ফাও উপত্যকা ইরানের হাতছাড়া হয়ে যায়। ওই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের ভারসাম্য ইরানের দিক থেকে ইরাকের পক্ষে চলে যাচ্ছে। ইরানের কাছ থেকে ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধারের পর ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম তার দেশের বসরা নগরীর পূর্বদিকে অবস্থিত শালামচে এলাকাটি ইরাকের কাছ থেকে পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন। ইরাকের তিন ডিভিশন সেনার এক বিশাল বাহিনী শালামচে’তে হামলা চালায় এবং তারা অল্প সময়ের মধ্যে ইরানের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে ফেলে। এভাবে শালামচেও ইরানের হাতছাড়া হয়ে যায়। এমন সময় এ ঘটনা ঘটে যখন ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধারের আগ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ইরান ইরাকের চেয়ে তুলনামূলক শক্তিশালী অবস্থানে ছিল।

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও বিশেষজ্ঞ মহলে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে থাকে তা হলো- এবার হয়তো ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতি ঘটবে। গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়, ইরাকি সেনাবাহিনী আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় চলে যাওয়ার কারণেই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইরান অনেকটা বেকায়দা অবস্থায় পড়ে যাওয়ার কারণে তেহরান যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব মেনে নেবে বলে পর্যবেক্ষকরা আভাস দেন। এতদিন যুদ্ধে ইরানের অবস্থান শক্তিশালী থাকার কারণে তেহরান তার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায় না করে রণেভঙ্গ দিতে রাজি হচ্ছিল না।

শালামচে ও ফাও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ইরানের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা হয়। ইরান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের ধারাগুলোতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা জোরদার করে। এছাড়া, ইরানি নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে যুদ্ধের জন্য জনগণের পক্ষ থেকে সাহায্য ও সমর্থন বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। যে সময়টিতে যুদ্ধের ময়দানে ফাও এবং শালামচে হাতছাড়া হয়ে যায় ঠিক সে সময়ে ইরানে সংসদ নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলছিল।  ১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই ইরানে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সারাদেশের জনগণ সে সময় যুদ্ধের চেয়ে নির্বাচন নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল। নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সংসদ ও জনগণের উদ্দেশে পাঠানো এক বাণীতে ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেন, “নির্বাচনের ব্যস্ততা শেষ হয়েছে। এখন আবার যুদ্ধের ময়দান ও ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন ও সহায়তা জোরদার করতে হবে।”

ইরানি যোদ্ধারা শালামচে থেকে পশ্চাদপসরণ করার পর ইরাকি বাহিনী ‘মাজনুন’ দ্বীপপুঞ্জের দিকে দৃষ্টি দেয়। ইরাকি সেনাবাহিনী আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে যাওয়ার পর ফাও উপত্যকা ছিল তাদের অভিযানের প্রথম লক্ষ্যবস্তু। এরপর শালামচে পুনরুদ্ধারের পর মাজনুন  দ্বীপপুঞ্জে তারা আরো বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধারের সময় ইরাকি বাহিনী ইরানি যোদ্ধাদেরকে হত্যা করার দিকে বেশি মনযোগী ছিল এবং এ কারণে তারা ওই উপত্যকায় মোতায়েন ইরানি যোদ্ধাদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু মাজনুন দ্বীপপুঞ্জে তারা কৌশল পরিবর্তন করে এবং ইরানি যোদ্ধাদের আটক করে যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ভারী করার চেষ্টা চালায়। এখানেও ইরান  কয়েক বছর আগের চেয়ে তুলনামূলক বেকায়দা অবস্থায় পড়ে যায়। কারণ, নিজের দখলে থাকা ইরাকের ভূখণ্ডগুলো একের পর ইরাকি বাহিনীর হাতে চলে যাওয়ার কারণে নিজের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে যে কঠোর অবস্থান প্রয়োজন তা ইরানের হাতছাড়া হয়ে যায়।

এ সময় বিশ্বের এক নম্বর শয়তান আমেরিকা ইরাকি বাহিনীকে সর্বোতভাবে সমর্থন দেওয়ার অংশ হিসেবে পারস্য উপসাগরের আকাশে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে। এ ঘটনায় বিমানটির ২৯০ জন আরোহীর সবাই প্রাণ হারান। বিমানটি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর আব্বাস শহর থেকে উড্ডয়ন করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যাচ্ছিল। এ ঘটনাটি ছিল একটি মানবিক বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়। আমেরিকা নিজেকে এই ঘটনার দায় থেকে মুক্ত করার জন্য বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার পরপরই দাবি করে, এটি ছিল ইরানের একটি সামরিক বিমান এবং এটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজে হামলা করতে চেয়েছিল। ইরানি পাইলটকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার পরও সে তাতে কান না দেওয়ায় বিমানটিকে গুলি করা হয়েছে।

কিন্তু পরবর্তীতে বিমানটি যে যাত্রীবাহী ছিল তা প্রমাণিত হওয়ার পর আমেরিকা দাবি করে, ওই এলাকার আকাশে ইরানের জঙ্গিবিমান ছিল এবং আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ থেকে ইরানি বিমান লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। মার্কিন বাহিনী এই ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ করে তেহরানকে একথা বোঝানোর চেষ্টা করে যে, চলমান যুদ্ধে ইরাককে রক্ষা করার লক্ষ্যে ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের মানবতা বিরোধী অপরাধ করতে ওয়াশিংটন কার্পণ্য করবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করাকে একটি বীরোচিত ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে যে যুদ্ধজাহাজ থেকে বিমানটিকে গুলি করা হয়েছিল সেটির ক্যাপ্টেনকে পদক প্রদান করে সম্মানিত করেন।

নিজের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত হলেও ইরান আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো থেকে বিরত থাকে। কারণ, ওই মানবিক বিপর্যয়ের পরপরই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরাখবর ও বিশ্লেষণে আমেরিকাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বিশ্ব জনমত ইরানের পক্ষে চলে আসে। ইরান যুদ্ধের ময়দানে জবাব না দিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায়। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে ইরান মূলত বিগত আট বছরের যুদ্ধের জন্য ইরাকের শাসক সাদ্দামকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করে যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে চেয়েছিল।#

র্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ