মার্চ ০৯, ২০২২ ২০:২২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরাকের ফাও উপত্যকা, শালামচে অঞ্চল ও মাজনুন দ্বীপপুঞ্জ ইরানের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং আমেরিকার গুলিতে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করব।

ইরাক-ইরান যুদ্ধে আমেরিকা ইরাকের পক্ষ অবলম্বনের বিষয়টি মোটেও গোপন রাখার চেষ্টা করেনি বরং ফলাও করে প্রচার করে। এরই অংশ হিসেবে যে যুদ্ধজাহাজ থেকে গুলি করে ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করা হয় সেই ভিনসেস যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানজনক পদক দিয়ে পুরস্কৃত করে ওয়াশিংটন।  এদিকে যুদ্ধের ময়দানে ইরাকি বাহিনী আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফ্রন্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইরাকিরা মাত্র তিন মাসের মধ্যে দু’দেশের দক্ষিণ সীমান্তে ইরানের দখলে থাকা নিজেদের সমস্ত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে। ফলে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে ইরাকের অবস্থান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শক্তিশালী হয়। ইরাকি সেনা কমান্ডাররা ইরানকে চেপে ধরার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায় এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগাতেও তারা কার্পণ্য করেনি।

উদ্ভূত পরিস্থিতি মোটেও ইরানের অনুকূলে ছিল না। একদিকে ইরাকের দখলীকৃত সব ভূখণ্ড হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় জাতিসংঘে বাগদাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অন্যদিকে গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে সুবিধা করে ওঠা ইরানের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে ইরানের নীতি নির্ধারকরা জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখার প্রয়াস পান। যুদ্ধের সর্বোচ্চ কমান্ডার হাশেমি রাফজানজানি তেহরানের জুমার নামাজের খুতবায় জনগণকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, শত্রু  যখন দেখবে এত কিছু সত্ত্বেও ইরানি জনগণ পিছু হটতে রাজি নয় তখন তারা ভিন্ন উপায় অবলম্বনে বাধ্য হবে।

এদিকে যুদ্ধের পরিস্থিতি ইরানের এতটা প্রতিকূলে চলে গিয়েছিল যে, কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইরাক সরকার উপলব্ধি করে ইরানকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করার জন্য তেহরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এ কারণে ইরাকি বাহিনী ইরানের অভ্যন্তরে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা বাড়িয়ে দেয়। সম্ভাব্য শান্তি আলোচনায় নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী রাখার লক্ষ্যে এরকম পাশবিক আচরণ করে সাদ্দাম সরকার। ইরাকি কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও তাদের এ পরিকল্পনার কথা ফুটে ওঠে। ইরাকের তৎকালীন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজার হামদুন ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে এক বক্তব্যে বলেন, “ইরানকে পরিপূর্ণ শান্তি গ্রহণ করতে বাধ্য করার জন্য আমরা তেহরানের ওপর সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখব।”

যুদ্ধের এই সময়টিতে ইরানের জন্য আরেকটি বড় বিপদের কারণ ছিল পিপলস মুজাহেদিন নামে এদেশের ইসলামি শাসনব্যবস্থা-বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা যুদ্ধের শেষের দিকে ইরাকি বাহিনীর পক্ষ হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে ময়দানে অবতীর্ণ হয়।  তারা ইরাকি বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র হাতে ইরানের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ইরাকি শাসক সাদ্দাম তার দেশের পাইলটদের উৎসাহ প্রদানের এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা আর কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাব যে, পিপলস মুজাহেদিনের সদস্যরা ইরানের আরো গভীরে প্রবেশ করেছে।”

এ অবস্থায় নিজ সীমান্তে ইরাকের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইরান ইরাকের দখলীকৃত ভূখণ্ডগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পাশাপাশি ১৯৮৮ সালের ১৮ জুলাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওই দিন জাতিসংঘ মহাসচিবকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেয়ার কথা জানিয়ে দেন।

বাহ্যিকভাবে ইরান হঠাৎ করে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আসলে এটি ছিল যুদ্ধের শেষের বছরগুলোর সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতির ফসল যা ইরানের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। এই সময়টিতে ইরাকি শাসক সাদ্দাম তার সেনাবাহিনীতে কয়েক গুণ লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করে বাগদাদের সামরিক শক্তিকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। সেইসঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চতুর্মুখী সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়ার কারণে ইরাকি বাহিনীর সামরিক শক্তি হঠাৎ করে ইরানের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ইরানের নীতি নির্ধারকরা যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়টি মেনে নেয়াকেই দেশের জন্য মঙ্গলজনক মনে করেন। ফলে তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেন।

যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে বিমান শক্তির পাশাপাশি রাসায়নিক অস্ত্রের দিক দিয়ে ইরাকের শক্তি এতটা বেড়ে যায় যে, দেশটি রক্ষণাত্মক ভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তারা ইরানের কাছ থেকে নিজেদের সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করার ফলে যুদ্ধের ময়দানে ইরান যতটা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল তার সব তেহরানের হাতছাড়া হয়ে যায়। ইরানের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যও সময়, সমরাস্ত্র ও লোকবলের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হঠাৎ করে সম্ভব ছিল না।  ইরানের পক্ষ থেকে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার আরেকটি কারণ ছিল ইরানের ওপর ইরাকি বাহিনীর যথেচ্ছা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। ইরাকিরা ইরানের বেসামরিক অবস্থানগুলোতে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। এ সম্পর্কে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি বলেন, “হালাবজা শহরে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের পর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সম্ভাব্য গণহত্যার ব্যাপারে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা চাইনি জনগণ বেঘোরে প্রাণ হারাক। ইমাম ঠিক এ কারণে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন।#

র্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ