আসমাউল হুসনা (পর্ব-৬৫)
মহান আল্লাহর পবিত্র নামগুলো কেবল একটি শব্দ নয় বরং ব্যাপক অর্থবোধক বিষয়। বিভিন্ন সময়ে এইসব নামের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠে। মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার তালিকাভুক্ত এমনই দুই নাম হল মুকাদ্দিম ও মুওয়াখ্খির।
মুকাদ্দিম শব্দের আভিধানিক অর্থ হল যিনি অগ্রিম প্রেরক ও অগ্রগামী। তবে মহান আল্লাহর নাম হিসেবে এর অর্থ হল মহান আল্লাহ প্রতিটি বস্তুকে তার যথাযোগ্য স্থানে রাখেন। তিনি যা চান তা আগে পাঠান ও যা চান তা পরে পাঠান। যেমন, পিতার অস্তিত্ব বা আবির্ভাব ঘটে পুত্রের জন্মের আগে। আর এটাই তো হওয়া উচিত। অনুরূপভাবে নবী-রাসুল ও আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্বের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য পেতে চান বলে মহান আল্লাহ তাঁদেরকে অগ্রণী বা অগ্রগামী করেন।
মহান আল্লাহ হযরত মুসাকে ওহির মাধ্যমে তাঁকে নবী করার ও সম্মানিত করার রহস্য জানিয়ে বলেছিলেন: আমি সব বান্দাহদের বিশ্লেষণ করে এটা দেখেছি যে অন্য সবার তুলনায় আমার ব্যাপারে বিনম্রতায় তুমি বেশি অগ্রগামী ও তুমি বেশি নতজানু। তুমি হচ্ছ সেই শিশুর মত যাকে তার মা মারলেও সে মায়ের কাছেই আশ্রয় নেয়। তুমি আমার প্রতি তোমার মুনাজাতে বলে থাকো: হে খোদা! একমাত্র তোমারই ইবাদত করি ও একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য চাই। তোমার প্রতি আমার বিশেষ মহব্বতের কারণ এটাই।
তাই এটা স্পষ্ট ইমান ও সৎকর্মের তীব্রতার আলোকে মহান আল্লাহ কাউকে অন্য কারো চেয়ে বেশি সম্মানিত ও বেশি অগ্রগণ্য করেন। প্রখ্যাত সুন্নি মনীষী محمد بن احمد ذهبیমুহাম্মাদ বিন আহমাদ যাহাবির লেখা 'মিযান আল এ'তেদাল' শীর্ষক বইয়ে উল্লেখিত হাদিস তথা মহানবীর-সা. ভাষ্য অনুযায়ী হাশরের ময়দান থেকে বেহেশতে সবার আগে প্রবেশ করবেন হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহ আলাইহা।
ইহকালে কোনো বিষয়ে অগ্রণী হওয়া বা বেশি সম্মানিত হওয়ার ক্ষেত্রে এর নিজস্ব সূত্র, বিধি-বিধান বা নীতিমালা রয়েছে। তবে এসবই মহান আল্লাহর ইচ্ছা থেকেই উৎসারিত। মহান আল্লাহ ইহকাল ও পরকালে এমন সব উপায়-উপকরণ যুগিয়ে দিয়েছেন যে মানুষ সেসবের মাধ্যমে উন্নতির সোপানগুলো অতিক্রম করে থাকে। এসব উপায়-উপকরণের মধ্যে রয়েছে- কাজ, খোদা-সচেতনতা ও ইমান, জ্ঞান, বিনয় ও নম্রতা .... ইত্যাদি।
তাই মুমিন ব্যক্তিরা নানা উপকরণ ব্যবহার করে ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাফির ও মুশরিকদের চেয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করেন। তাঁদের এ বিশ্বাস রয়েছে যে যদি আল্লাহ তাদেরকে অগ্রণী করতে চান তাহলে কোনো শক্তিই তা ঠেকাতে সক্ষম নয়।
দ্বীন ও ইমানে নিজের দৃঢ়তা ও অগ্রণী ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী -আ. বলেছিলেন, আমি আমার কর্তব্য পালনে তৎপর ছিলাম। যখন অন্যরা নিজেদের কর্তব্য পালনের সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। আমি এগিয়ে এসেছিলাম যখন অন্যরা নিজেদেরকে গোপন করে রেখেছিল। আমি কথা বলেছিলাম যখন অন্যরা নীরবে মুখ বন্ধ করে বসেছিল। যখন আমি আল্লাহর নূর নিয়ে চলেছিলাম তখন অন্যরা বিফল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে কণ্ঠস্বরে আমিই ছিলাম সবচেয়ে নিম্ন; কিন্তু অগ্রগামীতায় আমি ছিলাম সর্বোর্ধে।
মহান আল্লাহর মুআখ্খির নামের অর্থ যিনি পিছিয়ে দেন বা পশ্চাতে পাঠান। মহান আল্লাহ কাউকে জ্ঞান, খোদা-সচেতনতা বা তাকওয়া, সুপথ প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়ে পিছিয়ে দেন প্রজ্ঞা, কৌশল ও খোদায়ি রহমতের আলোকে। মহান আল্লাহ মুআখ্খির বলেই কাফির-মুশরিক ও জালিমদেরকে পেছনে ঠেলে দেন এবং দুনিয়াতে তারা নোংরাদের শ্রেণীভুক্ত হয় ও পরকালে হয় জাহান্নামি।
মানুষ বিচ্যুত পথে চলায় মহান আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও পরকালে করেন অসম্মানের শিকার। তাই মুমিন সব সময় সৎকাজে অগ্রণী থাকার চেষ্টা করেন ও বিচ্যুতির পথ এড়িয়ে চলেন যাতে অসম্মান ও লাঞ্ছনা নেমে না আসে।
মহান আল্লাহ পাপীদের পাপাচার ও নোংরা কাজের শাস্তি বিলম্বিত করেন যাতে তারা তওবার সুযোগ পায়। অন্যদিকে মহান আল্লাহ সুপথ লাভের সব পথই খোলা রেখেছেন সবার জন্য।
মহান আল্লাহর মুআখ্খির নামের আলো যাদের ওপর পড়েছে তারা কথা ও কাজে অপছন্দনীয় সব কিছু এড়িয়ে চলেন এবং মহান আল্লাহ যা কিছু অপছন্দ করেন তা তারাও অপছন্দ করেন ও সেসবকে তুচ্ছ মনে করে এড়িয়ে চলেন। মুমিন ব্যক্তি সর্বপ্রথম নিজের কুপ্রবৃত্তিকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করেন। কারণ, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু এই কুপ্রবৃত্তি। উদ্ধত নফস দুমড়ে মুচড়ে নির্মূল করে ফেলা সব মু'মিনের দায়িত্ব।
মহান আল্লাহর অস্তিত্ব হচ্ছে অনিবার্য অস্তিত্ব তথা ওয়াজিবুল ওয়াজুদ। অন্যদিকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছু বা সৃষ্টিকুলের অস্তিত্ব হচ্ছে সম্ভাব্য বা সম্ভবপর অস্তিত্ব এবং তা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে মহান আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন বলে তিনি সব কিছুর চেয়ে অগ্রণী বা মুকাদ্দিম। সব কিছুই ধ্বংসশীল কেবল মহান আল্লাহই অবিনশ্বর। আর তাই তিনি এদিক থেকে সবার পেছনে বা মুআখ্খির। অন্যদিকে তিনি সবার বা সব সৃষ্টিরই সঙ্গে আছেন।
পবিত্র কুরআনের ৫৭ নম্বর সুরা তথা সুরা আল হাদিদ-এ আল্লাহ বলছেন: তোমরা যেখানেই থাকোনা কেন তিনি তথা আল্লাহও তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন। অন্য কথায় মহান আল্লাহর অস্তিত্ব সব কিছুকে ঘিরে রেখেছে তবে তা বস্তুগত বা স্থানগতভাবে নয়। আমরা আল্লাহর সঙ্গে নাও থাকতে পারি কিন্তু আল্লাহ সব সময়ই আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। আর এ জন্যই আধ্যাত্মিক সাধকরা বলে থাকেন: আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ আল্লাহ সব কিছুর সঙ্গেই আছেন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আমরা যেন আল্লাহর সঙ্গে থাকি।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।