ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-১১৪) : ইরানের বিজয়ে ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বের ভূমিকা
গত আসরে আমরা ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ব্যাপক সহযোগিতা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের স্বীকারোক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরাকি শাসক সাদ্দামের ইরান আগ্রাসনের কারণ ও তার প্রতি দুই পরাশক্তির পূর্ণ সমর্থন সত্ত্বেও ইরানের বিজয়ে ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে কথা বলব।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আট বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইরান শুধু ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেনি সেইসঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিল। এ সম্পর্কে একটি পশ্চিমা গণমাধ্যম লিখেছে: ফ্রান্সের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত ন্যাটো জোটের একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে ইরাকি সেনাবাহিনীর অ্যান্টোনভ বিমানে করে নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র বাগদাদে নেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশটি যদি ইরাককে সামরিক সাহায্য দেওয়া তিন সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে তাহলে বাগদাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তাদের অন্যান্য সহযোগী দেশ ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে তেহরানের ওপর এ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। কাজেই তারা সাদ্দাম প্রশাসনকে সব রকম সমরাস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে যায়।
অথচ পশ্চিমা দেশগুলো ওই একই সময়ে ইরানের কাছে কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত বিক্রি করেনি। কিন্তু তারা ইরাকের সাদ্দাম সরকারের হাতে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দিয়েছে ইরানি নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করার জন্য। এখনো অনেক ইরানি যোদ্ধা ওই রাসায়নিক অস্ত্রের আঘাতে আহত অবস্থায় দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন এবং প্রায় প্রতিদিন রাসায়নিক অস্ত্রের আঘাতে আহত কোনো না কোনো ইরানি যোদ্ধার শাহাদাতবরণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানি জনগণ তাদের দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে চিরতরে বিদায় জানিয়েছিল। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মতো কৌশলগত অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ আমেরিকার হাতছাড়া হয়ে যায় এবং বিশ্বের স্বাধীনতাকামীদের সামনে ইরান হয়ে ওঠে অনুকরণীয় আদর্শ।
ঠিক এ কারণেই আমেরিকা বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কারো পক্ষে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ইরানি জনগণ যখন বিপ্লব পরবর্তী বিধ্বস্ত দেশটিকে ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে ব্যস্ত তখনই তাদের ওপর নানাবিধ বিপদ চাপিয়ে দেয়া হয়। ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতিগত দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া, দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ- ইত্যাদি ছিল ইরানের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। কিন্তু শত্রুরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের কিছু কিছু দিক সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ। যেমন জনগণের ওপর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.)র সুদূরপ্রসারী প্রভাবের মাত্রা অনুধাবন করা ছিল বহিঃশক্তিগুলোর জন্য অকল্পনীয় বিষয়।
ইমাম খোমেনী (রহ.) যুদ্ধ শেষে এক ভাষণে বলেন: আট বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ন্যাটো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও নতজানু আরব সরকারগুলো সবাই মিলে সাদ্দামকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরান তাদের সবার বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। আট বছরের যুদ্ধের পর তারা ইরানের এক বিঘত পরিমাণ জায়গাও নিজেদের দখলে রাখতে পারেনি। ইসলামি বিপ্লবের রূপকার তাঁর অন্য এক ভাষণে বলেন: বিগত ২০০ বছরে ইরান যতগুলো যুদ্ধে অংশ নিয়েছে তার সবগুলোতে পরাজিত হয়েছে। শুধুমাত্র এই আট বছরের যুদ্ধে ইরান পরাজিত হয়নি। আমেরিকা যা চেয়েছিল ঠিক তার বিপরীতটি হয়েছে। এ সম্পর্কে ইরানের সাবেক সংসদ স্পিকার ও আট বছরের যুদ্ধের প্রধান কমান্ডার হাশেমি রাফসানজানি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে পাশ্চাত্য ইরানে নিজেদের সবচেয়ে বড় স্বার্থ হাতছাড়া করে। এ কারণে একই ধরনের বিপ্লব যাতে বিশ্বের আর কোনো দেশে হতে না পারে সেজন্য তারা ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।
ইরানের ওপর আট বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের আগে ইরাক সরকার ইরানের সীমান্তে ৬৩৬ বার আগ্রাসন চালায়। এবং অবশেষে এক সপ্তাহের মধ্যে গোটা ইরান দখল করা সম্ভব হবে- এই আশায় ইরাকি শাসক সাদ্দাম ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরানে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন। সাদ্দাম ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর আগে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এক সপ্তাহ পরে তেহরানে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু ইরাকি বাহিনী ৩৫ দিন পর্যন্ত ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খোররামশাহরের প্রবেশ পথে আটকে থাকে। এ থেকেই সাদ্দামের ইরান দখলের স্বপ্ন ধুলিস্যাত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ ওই সময় ইরানের সেনাবাহিনী সুসংগঠিত ছিল না এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে তার পক্ষে পেশাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে ইরানি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর সে দুর্বলতা কেটে যায়।
ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন শুরু করার এক সপ্তাহ পর ইরান আত্মরক্ষামূলক অবস্থান ছেড়ে আক্রমণাত্মক হামলা শুরু করে। মাত্র নয় মাসের মধ্যে ইরানি যোদ্ধারা তাদের দেশের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ পুনরুদ্ধার করে এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে সাদ্দাম বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর দুরদর্শী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল ইরানের এই বিজয়ের প্রধান কারণ। ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন প্রধান ইরাকি শাসক সাদ্দামের কাছে পাঠানো এক বার্তায় ইমাম খোমেনী সম্পর্কে বলেন: এই ব্যক্তির ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। আগুন ধরে যাওয়া জঙ্গলের চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। কারণ, এই আগুন প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাহা ইয়াসিন রমাজান বলেন, ইসলামি বিপ্লবের বিস্তৃতি প্রতিহত করার জন্যই তার দেশ ইরানে হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, আলজিয়ার্স চুক্তি বা কয়েকশ’ কিলোমিটার ভূমি দখল করার উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়নি। বরং ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা ছিল এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।