ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-১১৬) : ইরানের বিজয়ের কারণ
গত আসরে আমরা ইরাকি শাসক সাদ্দামের ইরান আগ্রাসনের কারণ ও তার প্রতি দুই পরাশক্তির পূর্ণ সমর্থন সত্ত্বেও ইরানের বিজয়ে ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা ইসলামি বিপ্লবের মহান এই নেতার দৃষ্টিতে আট বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইরানের বিজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম ও তার সহযোগীরা ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা ও ইরানকে কয়েক টুকরা করার অভিসন্ধি নিয়ে ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এদেশের ওপর আগ্রাসন চালায়। সাদ্দাম চেয়েছিল ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় আরবি ভাষাভাষী এলাকাগুলোকে ইরাকি মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তু সাদ্দাম এই দুই লক্ষ্যের কোনোটিই অর্জন করতে পারেননি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেন, আট বছরের যুদ্ধে আমরা যে জয়ী হয়েছি তা প্রমাণ করার জন্য কোনো শপথ করার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধে জয়ের প্যারামিটার কি? অতো বড় সমরশক্তি নিয়ে যদি কোনো শত্রু একটি দেশের ওপর হামলা চালায় এবং আট বছর যুদ্ধের পর যদি দেখা যায়, পরিস্থিতি আট বছর আগের মতোই রয়ে গেছে এবং আক্রান্ত দেশটির এক ইঞ্চি জায়গাও আগ্রাসী শক্তি দখল করতে পারেনি তখন আক্রান্ত দেশটিকে ওই যুদ্ধে বিজয়ী বলা যায়।
হযরত ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে যেমন ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিজয়ী হয়েছে তেমনি তারই দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় ইরাকের চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধেও বিজয়ী হয়েছে ইরান। আর এ বিজয় ছিল ইরানের জন্য একটি বিশাল অর্জন। কারণ, বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে ইরানের জন্য এটি ছিল প্রথম কোনো যুদ্ধ যেখানে দেশটিকে এক বিঘত ভূমিও শত্রুর হাতে তুলে দিতে হয়নি কিংবা বিদেশি সামরিক উপদেষ্টাদের সহযোগিতা নিতে হয়নি। ইরানি জনগণ বরং নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এমনকি তুমুল যুদ্ধের মধ্যেও ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনসহ সবগুলো নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের ২০০ বছরের বিভিন্ন যুদ্ধে ইরানের বিশাল ভূখণ্ড পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত হয়েছে।
যুদ্ধ কোনো কল্যাণকর বিষয় নয় বরং গোটা মানবজাতি যুদ্ধকে ঘৃণা করে। কিন্তু তারপরও ইতিহাস জুড়ে যুদ্ধ থেকে মানবজাতি অনেক মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যুদ্ধে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু অর্জনও রয়েছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ২১৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “তোমাদের উপর যুদ্ধের বিধান দেয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।” ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে, বাহ্যিকভাবে যুদ্ধ কোনো পছন্দনীয় বা নিন্দনীয় বিষয় নয় বরং কারা যুদ্ধ করছে এবং তাদের উদ্দেশ্য কি- তার ওপর নির্ভর করে বোঝা যায়, এটি আগ্রাসী যুদ্ধ নাকি পবিত্র জিহাদ। আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে তিনি ঐশী ও মানবিক যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন। ইমাম খোমেনী আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা যুদ্ধকে সরাসরি ইসলামি জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইসলামি বিপ্লবের এই মহান নেতা শুধু ইরান নয় বরং বিশ্বের যেকোনো স্থানে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষাকারী যেকোনো যুদ্ধকে জিহাদ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক ভাষণে বলেন: ধর্ম ও মাতৃভূমি রক্ষা করার যুদ্ধে যত কষ্ট ও জানমালের যত ক্ষতিই হোক না কেন মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এর অর্জনও অনেক মূল্যবান। জনগণের প্রতি শাহ সরকারের বিশ্বাসঘাতক আচরণের কারণে যে ইরান একদিন পশ্চিমাদের তাবেদার ও একটি মৃতপ্রায় দেশে পরিণত হয়েছিল সেই ইরান ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এরপর সাদ্দামের মতো অপশক্তি মার্কিনীদের সহযোগিতায় ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে এদেশের তরুণ সমাজ মাতৃভূমি রক্ষার এক বিজয়গাঁথা রচনা করে। তারা বিশ্বের বুকে এক শক্তিশালী ও সম্মানিত ইরানকে তুলে ধরে যা দেখে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে যায়।
ইরানের এক ইঞ্চি ভূমিও হাতছাড়া না হওয়া, ইসলামি শাসনব্যবস্থা টিকে থাকা এবং চরম প্রতিকূল পরিবেশে দীর্ঘ আট বছর ধরে একটি অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেইসঙ্গে এ যুদ্ধে ইরানের তরুণ সমাজের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়া এবং যুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠন করতে পারাটাও ছিল চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের অন্যতম অর্জন। ইসলামি বিপ্লবের আগে শাহ সরকারের শাসনামলে যেখানে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় সব সমরাস্ত্রের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো সেখানে বিপ্লবের পর বিশেষ করে আট বছরের যুদ্ধের পর প্রতিরক্ষা শিল্পে ইরান প্রভূত উন্নতি সাধন করে। বর্তমানে ইরান সমরাস্ত্রে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বরং একটি অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধের ফলে।
এ সম্পর্কে ইমাম খোমেনী আরো বলেন, আমরা শুধুমাত্র ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে, আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে এবং আত্মবিশ্বাসী নারী-পুরুষের প্রবল প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ দীর্ঘমেয়াদী একটি অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। আমরা আল্লাহর কাছে এ কারণে শোকরগুজারি করছি যে, যুদ্ধে কোনো বহিঃশক্তির সাহায্য আমাদেরকে নিতে হয়নি ফলে কোনো পরাশক্তির কাছে আমাদের কোনো ঋণ নেই। যুদ্ধে আমাদের তরুণ সমাজ যখন অস্ত্র সংকটের সম্মুখীন হয়েছে এবং কোনো বহিঃশক্তির কাছ থেকে অর্থের বিনিময়েও অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেনি তখন তারা নিজের সমরাস্ত্র নির্মাণের কারখানা স্থাপন করেছে। এ কারণে ইরান আত্মরক্ষার্থে সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।