মে ১৫, ২০২২ ১৭:৩৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে আট বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইরানের বিজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করেছি। আজকের আসরে আমরা ওই যুদ্ধে ইরানের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা করব।

ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট যুদ্ধ দীর্ঘ আট বছর ধরে চলে এবং এই যুদ্ধে ইরানের মতো স্বাধীনচেতা দেশ অনেক মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ইরানের এক ইঞ্চি ভূমিও হাতছাড়া না হওয়া, ইসলামি শাসনব্যবস্থা টিকে থাকা এবং এই দীর্ঘ সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পরিচালনা করা ছিল এসব অর্জনের অন্যতম। সাদ্দাম ও তার সহযোগীরা চেয়েছিল ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশ দখল করে ইরাকের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে। আর তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। কিন্তু সাদ্দাম এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে তার সহযোগীরা সম্মিলিতভাবেও তাদের সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং যুদ্ধ থেকে সৃষ্ট সংকট ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা তৈরি ছিল এ যুদ্ধে ইরানের আরেকটি বড় অর্জন।

ইসলামি বিপ্লবের মাত্র ১৯ মাসের মাথায় ইরানের ওপর আগ্রাসন চালান তৎকালীন ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেন। ইরানের সেনাবাহিনী তখনও বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতিতে নিজেকে ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এ অবস্থায় ইরানের তরুণ সমাজের বিপ্লবী চেতনা ও শাহাদাতপিয়াসী মনোভাব ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খোররামশাহরের তরুণ যোদ্ধারা এই চেতনা নিয়েই আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে টানা ৩৫ দিন পর্যন্ত শহরের প্রবেশদ্বারগুলোতে ঠেকিয়ে রাখে। তারা এই বিশ্বাস অর্জন করেছিল যে, শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও নিজস্ব সক্ষমতাকে পুঁজি করেই মাতৃভূমি ও বিপ্লবকে রক্ষা করতে হবে। আট বছরের যুদ্ধে ইরান এই অভিজ্ঞতা অর্জন করে যে, সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীলতার মাধ্যমে বড় বড় শক্তির বিরুদ্ধে বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এ সম্পর্কে ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেন, আমরা এ যুদ্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির কথিত শ্রেষ্ঠত্ব ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি। শুধু যুদ্ধের ময়দানে নয় সকল ক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব আমরা ভেঙে খান খান করে দিয়েছি।

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরান সত্যিকার অর্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হতে শিখেছে। ইরানি জনগণ অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে মিতব্যয়ী হওয়ার মাধ্যমে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। যুদ্ধের সময় যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ইরানের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে তখন এদেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন নতুন সমরাস্ত্র তৈরি করেছে। অথচ ইসলামি বিপ্লবের আগে সমরাস্ত্রসহ নানা ক্ষেত্রে ইরান ছিল সম্পূর্ণ বিদেশের ওপর নির্ভরশীল।ইমাম খোমেনীর ভাষায়, “এই যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অবরোধ আমাদের জন্য ছিল ঐশী উপহার যার ব্যাপারে আমরা এতকাল উদাসীন ছিলাম।”

ইমাম ইরানি জনগণকে উদ্দেশ করে আরো বলেন, আপনারা মোটেও এ আশা করবেন না যে, আপনাদের প্রয়োজন বিদেশিরা এসে পূরণ করে দেবে কিংবা আপনাদের লক্ষ্য অর্জনে বিদেশিরা সহযোগিতা করবে। স্বাধীনচেতা ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে নিজেদেরকেই চেষ্টা করতে হবে।  

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল ছিল আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গণমানুষকে অংশগ্রহণ করানো। তিনি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাতে দুই কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। অথচ তখন ইরানের মোট জনসংখ্যাই ছিল মাত্র সাড়ে তিন কোটি। ইমাম খোমেনী (রহ.) শত্রুকে এ বিষয়টি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, এদেশের সকল মানুষ মিলে যেমন বিপ্লব করেছে তেমনি বিপ্লবী সরকারকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্য রয়েছে। ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের যুদ্ধে বিজয়ে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা এ সম্পর্কে বলেন, পরাশক্তিগুলো ও তাদের পদলেহীরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে যে, খোমেনী যদি কখনও একাও হয়ে যায় তাহলেও সে কুফর, জুলুম, শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। আর আল্লাহর ইচ্ছায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে নিয়ে আমরা সকল পরাশক্তি ও জালিমের রাতের ঘুম হারাম করে দেব। ইমাম খোমেনী (রহ.) নিজেকে জাতির সেবায় একজন স্বেচ্ছাসেবক ভাবতেন এবং এ নিয়ে গর্ব করতেন। তিনি আল্লাহর কাছে চাইতেন কিয়ামতের দিন তার উত্থান যেন স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে হয়।তিনি প্রায়ই একটি কথা বলতেন: “আমি স্বেচ্ছাসেবী হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।”

প্রকৃতপক্ষে ইরান-ইরাক আট বছরের যুদ্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইরানের সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। আর আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ ফ্রন্টে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর উপস্থিতি না থাকলে এ যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত। ইরাক-ইরান যুদ্ধের শুরুতে বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর চেইন-অব-কমান্ড তখনও পরিপূর্ণভাবে ঠিক করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীও ছিল তখন সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত একটি সশস্ত্র বাহিনী যার যুদ্ধ করার কোনো প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছিল না। এছাড়া এই বাহিনীর সেনা সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ অবস্থায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সদস্যদের অভিজ্ঞতা বা যুৎসই প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও তাদের বিশাল সংখ্যা যুদ্ধে জয়লাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এদিকে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান একটি স্বাধীনচেতা ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরপরই এদেশের ওপর নানা ধরনের অবরোধ আরোপ করে বহিঃশক্তিগুলো। যুদ্ধের কারণে যখন দেশের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যায় তখন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রগুলোতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বাজেটের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এ অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর উপস্থিতি যুদ্ধের ব্যয় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। অন্য কথায় ইরানি জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিজেরাই যুদ্ধের একটা বড় অংশের বোঝা নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ