মে ১৫, ২০২২ ১৮:২১ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান আলাপনে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এবং এর গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবতা নিয়ে সাক্ষাৎকারের আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। আর আমাদের সাথে অতিথি হিসেবে আছেন ডেইলি স্টারের সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বিশিষ্ট টিভি উপস্থাপক ও সাপ্তাহিক এর সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা।

তিনি বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মারাত্মকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। এটি একটি কালো আইন। এই কালো আইন বাতিল করতে হবে। সম্পাদক পরিষদ যে সংশোধনের কথা বলছে তার সাথে আমি একমত নই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে একইসাথে সরকারকে গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গায় আন্তরিক হতে হবে।

তো চলুন আমরা আজকের আলোচনায় যাই। জনাব গোলাম মোর্তোজা রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সাংবাদিক সমাজের দায় প্রসঙ্গে বলব, সাংবাদিকরা নানা ধারায়, নানান মতে, ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন, ইউনিয়ন এবং রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে সাংবাদিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের জোরাল ভয়েস থাকে না। মিন মিন করে কখনও কখনও কিছু তারা বললেও সরকার তা শোনার প্রয়োজন বোধ করে না। তাছাড়া মূল ধারার সাংবাদিকরা ইউনিয়ন কিংবা সংগঠনগুলোর সাথে জড়িত না। যারা নেতৃত্বে থাকেন বেশিরভাগ সময় দেখা যায় তারা ট্রেড ইউনিয়ন করেন। তাদের ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষেত্রে তারা সফল হন কিন্তু গোটা গণমাধ্যমের জন্য তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না।

এখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এবং গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা টিকে থাকার অবস্থানে থাকবেন নাকি সরকারের সঙ্গে একধরনের আপোস করে থাকবেন নাকি সত্য প্রকাশ করে যে চ্যালেঞ্জ আসবে সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করবেন! সামনের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য এটা একটা পরীক্ষা!

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, প্রথম পর্বের আলোচনায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ রকমের প্রতিবন্ধকতা আছে। সেই প্রতিবন্ধকতা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সেজন্য অনেকগুলো দৃশ্যমান ব্যাপার আছে। তো আজকের আলোচনার শুরুতে জানতে চাইব, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে সরকার কিন্তু বরাবরই বলে আসছে দেশের গণমাধ্যম খুবই স্বাধীন। তবে সম্পাদক পরিষদের বিবৃতির মধ্যে তফাৎ রয়েছে। আপনার কথায়ও..তো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারানোর জন্যে সাংবাদিক সমাজের কোনো দায় আছে বলে আপনি কি মনে করেন?

গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, সাংবাদিক সমাজের দায় বলতে সাংবাদিকদের সংগঠন এবং ইউনিয়নগুলো  আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াত এই ধারায় বিভক্ত। আর এই ধারায় যখন বিভক্ত থাকে তখন যেটি হয়-ধরা যাক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তখন আওয়ামী লীগের ধারা চলতে থাকে। সাংবাদিকরা সঠিক কথা বলতে পারে না। সরকারের যে মত সেই মত অনুযায়ী চলে। আর বিএনপি এবং জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে একইরকমের ঘটনা ঘটে। সাংবাদিকরা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে জোরালো যে আওয়াজ তোলার কথা সেই আওয়াজটি তুলতে পারে না। এরফলে  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা নিপীড়নমূলক আইন তৈরি করে ফেলার ক্ষেত্রে সরকারের জন্য বড় একটা সুবিধা।

দ্বিতীয়ত- আমাদের সাংবাদিক সমাজের বড় একটা অংশ আছে যারা বিভিন্ন ইউনিয়ন করেন , বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত। এসব জায়গায় যেমন খুব ভালো সাংবাদিক যেমন আছে আবার বড় একটা অংশ আছে যারা সাংবাদিকতার সঙ্গে নেই। তারা মূলত সাংবাদিকতা করেন না; তারা ট্রেড ইউনিয়ন করেন, সাংবাদিকদের ইউনিয়ন করেন, রাজনীতি করেন। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর নেতৃত্বে যদি মূল ধারার সাংবাদিকরা না থাকেন বা যারা দায়িত্বে থাকবেন তারা যদি মূল ধারার সাংবাদিক না হন, মূল ধারার গণমাধ্যমের প্রতিনিধি না হন তাহলে জোরাল ভয়েস আসা খুব কঠিন। দুর্ভাগ্যজনক হলো বাংলাদেশের সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সাংবাদিক সংগঠনগুলো তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন না এবং তারা নানা প্রক্রিয়াতে সরকারের সঙ্গে একধরনের আপোস করে আছে। আর সেই আপোসের কারণে নেতারা হয়তো লাভবান হচ্ছেন কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নিপীড়নমূলক আইন, গ্রেপ্তার, হয়রানি, ভয় দেখানো, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। কখনও কখনও সাংবাদিক সমাজ মিন মিন করে কিছু বলার চেষ্টা করেন কিন্তু তাদের আসলে কোনো ভয়েস নেই এবং সরকার তাদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করে না।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তোজা, আপনি যে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার –নির্যাতনের কথা বলছিলেন  আইন সালিশ কেন্দ্রের একটা পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে-গত নয় মাসে ১৫৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু তাই নয় একটা বিষয় নিশ্চয়ই আপনি লক্ষ্য করেছেন- সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের  চার্জশীট এখনও দেয়া গেল না। তদন্তকারী সংস্থা  এখন পর্যন্ত ৮৮ বার পিছিয়েছে-আবারও সময় নেয়া হয়েছে। হয়নি সুরাহা। তো কেন সাংবাদিকদের ওপর বিশেষ করে মিডিয়ার উপরে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর যে নির্যাতন-অত্যাচার চালানো হচ্ছে-যেকথা আপনিও বলছিলেন- কেন এটা হচ্ছে? এর কারণ আসলে কি?

গোলাম মোর্তোজা: প্রথমত আমি বলব কতৃত্ববাদী সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ গণমাধ্যম। আর সেই গণমাধ্যম যাতে ভয়ের মধ্যে থাকে সেইরকম একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যের জায়গায় সরকার সফল।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে সাংবাদিকরা বহু দলে মতে বিভক্ত, দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত এবং তারা ব্যক্তিগত সুবিধা পদ পদবি পাওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের তদবির করে চলেন। কেউ কেউ পদ পদবি পেলে চুপ হয়ে যান; সাগর-রুনী হত্যার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। নানান জন নানাভাবে সুবিধা পেয়েছেন এবং তারা চুপ হয়ে গেছেন। এখন ৮৮ বার হয়েছে সেটি একশবার হবে তবে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হবে বলে আমি মনে করছি না। র‍্যাব কি তদন্ত করছে তার আগে যদিও কোনো কিছু বলা টিক না। তার চেয়ে বড় কথা গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং সবাই জানে সাংবাদিকদেরকে যদি মারা হয়, পেটানো হয়, হত্যা করা হয় তাহলে সেই ঘটনার কোনো তদন্ত হবে না এবং বিচার হবে না! অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে না। এই যে ধারাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এই কারণে আমার ধারণা হেলমেট পরে এসে হেলমেট বাহিনী সাংবাদিকদের পেটাতে পারে, সরকারি কর্মচারীরা সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। পুলিশ সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। যেকেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দিয়ে একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করাতে পারে। সেটা ভুয়া মামলা কিংবা মিথ্যা মামলা যাই হোক না কেন তাতে কোনো সমস্যা হয় না। কেননা এই কাজগুলো যারা করে তারা জানেই যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে বা কোনো কিছু করলে সাংবাদিকদের সংগঠন কিংবা সম্মিলিতভাবে সাংবাদিকরা তার পাশে এসে দাঁড়াবেন না। যেহেতু একেকজন একেক দল করেন একারণে সবাই ধরেই নিয়েছে যে সাংবাদিকদের মারলে কিংবা হত্যা করলে কারও কোনো কিছু হয় না। আর এ কারণে বাংলাদেশে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।

শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার সাক্ষাৎকার শুনছিলেন। ফিরছি খুব শিগগিরিই। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তোজা, সবশেষে যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে, ক্যাটিগরিকালি যদি বলেন-আপনি কি আশা করছেন বাংলাদেশের গণমাধ্যম মুক্ত বা স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারবে? আরেকটু জুড়ে দেব- সেটি হচ্ছে মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য কি কি পরামর্শ আপনি দেবেন।

গোলাম মোর্তোজা: প্রথমত আমি বলব মুক্ত গণমাধ্যম বলতে আপনারা যেটা আশা করছেন, প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশের সামনের সময়ে সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। এখন যে অবস্থার মধ্যে আছে-সামনের সময়টা যেহেতু ২০২৩ সালে নির্বাচন সে কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য আরো চ্যালেঞ্জিং হবে। মতপ্রকাশ, সত্যবলা এবং দোষ ক্রটি তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এ কারণে আমি বলব বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য আরেকটি দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম যদি এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসে তাহল পরিবেশ পরিস্থিতি সরকার বা অন্য কেউ অনুকূল করে দেবে এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে তার নিজের স্বার্থে, টিকে থাকার স্বার্থে, সাধারণ জনমানুষের কাছে আস্থা অর্জনের স্বার্থে এ দেশের গণমাধ্যমকে একধরনের সাহসী হতে হবে। একটি দুটি পত্রিকা সাহসী হলে হবে না। শুধু ডেইলি স্টার বা প্রথম আলো যদি সাহস দেখায় তাহলে হবে না; অন্যদেরকেও সাহস দেখাতে হবে, সত্য তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম যদি সম্মিলিতভাবে সত্য তুলে ধরার দিকে যায় তাহলে আমার ধারণা যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গায় একটু উন্নতি হতে পারে। তবে আমি সেই জায়গায় খুব বেশি আশাবাদী নই। তবে এই প্রতিকূল সময়ে যারা স্বাধীন মতপ্রকাশ করছে, সত্য তুলে ধরছে সেই জায়গায় দু তিনটি পত্রিকা বা দুটি পত্রিকা –ডেউলি স্টার ও প্রথম আলো তাদের কাজ যথাযথভাবে পালন করছে বা করার চেষ্টা করছে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে। অন্যান্য গণমাধ্যম তাদের অবস্থান বুঝে যদি দায়িত্বপালন না করে আমার ধারণা সেক্ষেত্রে অন্যান্য গণমাধ্যম বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সাধারণ জন মানুষের কাছে এদের কোনো আস্থা থাকবে না। তখন এইসব সাংবাদিকদের বা মিডিয়ার জীবন জীবিকা নির্বাহ করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। এখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এবং গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা টিকে থাকার অবস্থানে থাকবেন নাকি সরকারের সঙ্গে একধরনের আপোস করে থাকবেন নাকি সত্য প্রকাশ করে যে চ্যালেঞ্জ আসবে সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করবেন! সামনের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য এটা একটা পরীক্ষা! একবাক্যে এ সম্পর্কে কোনো উত্তর নেই, একবাক্যে কোনো পরামর্শ নেই। গণমাধ্যমের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং সময়। আর সেই চ্যালেঞ্জিং সময়ে বহু বিপদকে সামনে নিয়ে সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে সামনে এগোতে হবে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব গোলাম মোর্তোজা  বাংলাদেশে গণমাধ্যম সূচক নিয়ে যে পরিসংখ্যান এসেছে তা নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে বিভিন্নমহলে সেসব বিষয় নিয়ে রেডিও তেহরানকে দুই পর্বে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আবারও আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

গোলাম মোর্তোজা: আপনাদেরকে এবং দর্শক শ্রোতাদেরকে ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৪

ট্যাগ