মে ১৫, ২০২২ ১৮:৫৯ Asia/Dhaka

গত আসর থেকে আমরা নতুন প্রদেশ গুলেস্তানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই প্রদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, এখানকার আবহাওয়া এবং এখানকার জনবসতি নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি।

পুরাতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে এই প্রদেশটি ইরানের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ একটি প্রদেশ। কারণ এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক ব্যতিক্রমধর্মী বহু নিদর্শন। আর্কিওলজিস্টরা গুলিস্তানকে ইরানের সবচেয়ে সমৃদ্ধতম অঞ্চল বলে মনে করে।

আজ আমরা গোলেস্তানের প্রাচীন শহর গোম্বাদে কাবুসে যাবার চেষ্টা করবো৷ শহরটির এরকম নাম হবার একটা কারণ অবশ্য আছে৷ তার আগে বরং শহরটির নামের অর্থ জেনে নেওয়া যাক ৷ গোম্বাদ শব্দের অর্থ হলো গম্বুজ , আর কাবুস হলো নাম৷এখানে রয়েছে বিখ্যাত কাবুস গম্বুজ টাওয়ার৷এই টাওয়ারের বিখ্যাতির জন্যেই শহরের নামটি এরকম হয়েছে৷ সংক্ষেপে এই শহরটিকে গোম্বাদ বলা হয়৷ গোম্বাদ ইরানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত৷তেহরান থেকে এর দূরত্ব হলো ৪৯৩ কিলোমিটার৷গোম্বাদ শহরের অধিকাংশ অধিবাসীই তুর্কমেনী৷মরুশহর হবার কারণে এখানকার আবহাওয়া গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম আর শীতকালে নাতিশীতোষ্ণ থাকে৷

ইসলাম-পূর্ব যুগে যেসব শহর গড়ে উঠেছিল,গোম্বাদে কাবুস তাদের মধ্যে অন্যতম৷ হিজরী তৃতীয় এবং চতুর্থ শতাব্দীতে এই শহরের ব্যাপক খ্যাতি ছিল৷ কিন্তু ৬২০ হিজরীতে মোগলদের হামলায় শহরটি পুরোপুরি বিরান হয়ে গিয়েছিল৷ মোগলরা শহরটিকে এমনভাবে ধ্বংস করেছিল যে, তাদের ধ্বংসলীলার পর শহরটির ঐতিহ্যের নাম-নিশানা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি৷ বর্তমানে গোম্বাদে কাবুস শহরটি কাবুস টাওয়ারের অস্তিত্বের কারণে বিশেষভাবে পরিচিত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ৷ কাবুস টাওয়ারটি গোম্বাদে কাবুস শহরের কেন্দ্রে একটি টিলার উপরে অবস্থিত৷ এই টাওয়ারটি ইটের তৈরি বিশ্বের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ টাওয়ার হিসেবে পরিচিত৷ সহস্রাধিক বছরের পুরোণো এই টাওয়ারটি কেবল প্রাচীন ইরানের জন্যেই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যেই গর্বের একটি বিষয়৷ আর এ কারণেই গবেষক বা বিশ্ব পর্যটকদেরকে এই টাওয়ারটি বেশ আকৃষ্ট করেছে৷ পশ্চিমা ইরান বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আর্থার উফাম পোপ তাঁর "ইরানী স্থাপত্য" নামক গ্রন্থে কাবুস টাওয়ার সম্পর্কে লিখেছেন :

"আলবোর্য পর্বতমালার পূর্বপ্রান্তের নিম্নাংশে ইরানের স্থাপত্যকলার একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম রয়েছে ৷ এই শিল্পকর্মটি হলো কাবুস গম্বুজ ৷ এটা মূলত কাবুস ইবনে ভাশ্মগীরের সমাধি ৷" গোম্বাদের এই ইটের টাওয়ার ইরানের ইসলামী স্থাপত্যকলার অন্যতম একটি নিদর্শন ৷ পার্বত্য বা টীলাময় অঞ্চল এমনিতেই একটু উঁচু ৷ সেই উঁচু এলাকার মধ্যে পণেরো মিটার উঁচু একটি টিলা৷ ঐ টিলার উপরে স্থাপিত হয়েছে ৫৫ মিটার উঁচু এই টাওয়ারটি৷ এর নির্মাণকাল হচ্ছে হিজরী ৩৯৭ সাল ৷ আল যিয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ বাদশাহ কাবুস ইবনে ভাশ্মগীর নিজেই এটি নির্মাণ করেন৷ যিয়ারী শাসনামলে অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীর দিকে স্থাপত্যকলা ছিল রাযী এবং খোরাসানী স্থাপত্যশৈলী প্রভাবিত৷ খোরাসানী স্টাইলের স্থাপত্যকলাকে ইরানের ইসলামী স্থাপত্যকলার প্রাথমিক নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়৷ ইসলামের আবির্ভাবের পঞ্চাশ বছর পরে এই স্টাইলটির সূচনা হয় এবং চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে৷ খোরাসানী নির্মাণশৈলির বৈশিষ্ট্য হলো এটি খুব সহজ এবং সজ্জাগত জটিলতামুক্ত৷

রাযি স্থাপত্যকলার স্টাইলটির সূচনা হয় চতুর্থ শতাব্দিতে ৷ ইরানে মোগল আক্রমণ পর্যন্ত এই স্টাইলটি অব্যাহত ছিল৷ এই সময়টাতে ইরানী স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক উত্কটর্ষ সাধিত হয়৷ এ সময়কার স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যটি ছিলো নির্মাণকাজে ইটের ব্যবহার ৷ ইটের বিচিত্র এবং সর্বোত্তম ব্যবহার করে চমত্কাছর চমত্কাার সব স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়৷ পোড়ানো ইট , রোদে শুকানো ইট ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের ইট ব্যবহৃত হতো যেগুলোর রংও ছিল বিভিন্ন ধরনের৷ যেমন পোড়ানো ইটের রং ছিল লাল৷ রোদে শুকানো ইটের রং ছিল ধূসর ৷ আর বৃষ্টিপাতের ফলে ইটের রং কখনো ধানের রং অর্থাৎ বাদামী রং ধারণ করে ৷

সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই টাওয়ারটির এমনিতেই একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে ৷ তাছাড়া এই টাওয়ারটি কাফেলা বা পথযাত্রীদের পথের দিক-নির্দেশনাও প্রদান করে ৷ টাওয়ারটি বহুদূর থেকে দেখা যায় বলে গতিপথ ঠিক করতে এটি সহযোগিতা করে ৷ এই টাওয়ারটির ভেতরের ডিজাইন বৃত্তাকার এবং সাদামাটা ৷ আর বাইরের ডিজাইনটি বৃত্তাকার হলেও দশটি কোণ বিশিষ্ট৷ প্রত্যেক কোণেই কুফি হরফে খোদাই করে লেখা লিপীকর্ম দেখতে পাওয়া যায়৷ এগুলো ইটের তৈরি প্লেটে করা হয়েছে৷ কৌণিক এই টাওয়ারটির দক্ষিণ প্রান্তে একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে৷ দরোজাটির উচ্চতা সাড়ে পাঁচ মিটার এবং প্রস্থে এটি দেড় মিটার৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো হাজার বছর পেরিয়ে যাবার পরও টাওয়ারটি দৃঢ়তার সাথে আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ ফলে এটি যে বিশ্বের স্থাপত্যকলা বিশারদ কিংবা গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে-তাতে আর সন্দেহ কী !

ভাষা এবং গোত্রগত দিক থেকে এই প্রদেশটির লোকজন প্রধান দুটি পরিচয়ে পরিচিত। একটি গ্রুপ ফার্স নামে পরিচিত, অপর গ্রুপটি তুর্কেমেনী নামে পরিচিত। ফার্সরা কেন্দ্রীয় এবং দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করে। ফার্সদের মধ্যে স্থানীয় এবং অভিবাসী দুই ধরনের অধিবাসী রয়েছে। ফার্সরা গুরগানী, কাতুলী, ফান্দুরুসকি এবং মযান্দারা'নী ভাষায় কথা বলে। আর অপর গ্রুপটি হলো তুর্কেমেনী। এরা উত্তরাঞ্চলে গুরগান সমতলভূমিতে বসবাস করে ।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ