মে ৩০, ২০২২ ২০:৪৯ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।

আপনারা জানেন, বাংলাদেশ, ভারতসহ উপমহাদেশের কয়েকটি দেশে এখন গরমকাল। বাংলাদেশে এখন জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস। হাঁসফাঁস গরম। আম কাঁঠাল  জাম জামরুল পাকানো গরম। মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টি হলেও গরম কিন্তু বেশ। আর অতিরিক্ত গরম সব সময়ই মানুষের জন্য ক্ষতিকর। আর বেশি ক্ষতি শিশু এবং বয়স্কদের জন্য। এই গরমে সাধারণত যেসব রোগব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে সে সম্পর্কে তার প্রতিকার নিয়ে আজ কথা বলব বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. আবু কামরান রাহুলের সঙ্গে। তিনি, মেডিকেল অফিসার (মেডিসিন বিভাগ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি  তিনি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে বিশেষ ট্রেনিং করছেন।

রেডিও তেহরান: জনাব ডা. আবু কামরান রাহুল রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

ডা. রাহুল: আপনাকেও ধন্যবাদ।

রেডিও তেহরান: জনাব ড. আবু কামরান রাহুল, শুরুতেই আপনার কাছে জানতে চাইব-এখন তো বাংলাদেশে জৈষ্ঠ্য মাস। পুরোদমে গরমকাল চলছে। গরমে শারীরিক অস্বস্তি ও নানান রোগ-ব্যাধি দেখা দেয় শিশু ও বয়স্কসহ প্রায় সব বয়সীদের। তো সাধারণত কি ধরণের রোগ-ব্যাধি দেখা দেয় সে সম্পর্কে যদি আপনি বলেন।

ডা. আবু কামরান রাহুল: এখন যেহেতু গ্রীষ্মকাল সেকারণে প্রচণ্ড গরম ও আদ্র আবহাওয়ায় নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। এসব সমস্যা বা অসুখের মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে-পানি শূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন। গরমকালে এটি কমবেশি সবারই হয়ে থাকে। মাথা ব্যথা হতে পারে। তাপজনিত রোগ যেমন হিট ক্রামস, হিট সিনকব, হিট একজর্সন ও হিট স্ট্রোক হতে পারে।

ডিহাইড্রেশন

গ্রীষ্মকালে সর্দি, কাশি কিংবা ফ্লু'র আক্রমণ বেড়ে যায় সাথে হাপানি কিংবা অ্যাজমা'র আক্রমণও বেড়ে যায়।

চর্মরোগ বা ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। যেমন সানবার্ন, ঘামাচি কিংবা ছত্রাকের আক্রমণও বেশ বেড়ে যায় একইসাথে ব্রণও হয়ে থাকে।

খাদ্যের বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিং হয়ে থাকে। সাথে ডায়রিয়া এবং আমাশয় দেখা দেয়।

সংক্রমণ বা ইনফেকশাস ডিসেস যেমন হাম, মামস, জলবসন্তের প্রকোপও অনেক বেশি হয়ে থাকে এই গরমকালে।

গরমকালে কিছু জ্বর হতে দেখা যায়। এরমধ্যে কমন জ্বর হচ্ছে ভাইরাস জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর ও টাইফয়েড জ্বর।

এছাড়া চোখের সমস্যা হতে পারে গরমকালে। যেমন ধরুন কনজাংটিভাইটিস। কনজাংটিভাইটিস হলে চোখ লাল হয়ে ফুলে ওঠে, জ্বালা করে, চোখ কটকট করে, চোখ থেকে জল পড়ে এমনকি সমানে পিচুটি (শ্লেষ্মা জাতীয় পদার্থ) কাটার মতো সমস্যাও দেখা যায়। কনজাংটিভাইটিস হলে চড়া আলোতেও তাকাতে খুব কষ্ট হয়। কখনও কখনও হলদে রঙের পুঁজও সৃষ্টি হয়। সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যেই ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলি কমে আসে। এটি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের দ্বারা হয়ে থাকে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ অসুখ বা সমস্যা গরমকালে হতে পারে সেটি হচ্ছে- বিষণ্ণতা বা ড্রিপেশন। আমাদের কমিউনিটিতে এই বিষণ্ণতা খুব বেশি দেখা দেয় গরমকালে।

রেডিও তেহরান: চারিদিকে ভীষণ গরম? এই গরমে আপনি হিট স্ট্রোক, পেটের অসুখ, ত্বকের সমস্যা, হিট একজর্সন, সান বার্নসহ নানা রোগের কথা বললেন, তো হিট স্ট্রোক কি সে সম্পর্কে যদি বলেন।

ডা. আবু কামরান রাহুল: হিট স্ট্রোক হচ্ছে যখন আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়ার্স বা তার চেয়ে বেশি হয় এবং একইসাথে মস্তিষ্কে কিছু সমস্যা-যেমন অবচেতন হওয়া, অর্ধচেতন হওয়া কিংবা অজ্ঞান হওয়া। কারও এই অবস্থা সৃষ্টি হলে তাকে আমরা হিট স্ট্রোক বলি।

হিট স্ট্রোক

সাধারণত দীর্ঘ সময় বাইরে কিংবা গরম পরিবেশে কাজ করে থাকেন যেমন ধরুন, কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক,খেতমজুর ইত্যাদি। ধরুন কেউ দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে আছে-তারও হিট স্ট্রোক হতে পারে। এতে মাথাঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারেন অনেকেই। তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে মৃত্যুও হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাচ্চা, বয়স্ক ও যারা ওবেসিটিতে ভুগছে তারা হিট স্ট্রোকে সহজেই আক্রান্ত হয়। কিন্তু একটানা রোদে থাকলে গরমে ঘামের সঙ্গে শরীরের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায়।

আমাদের শরীরের ভেতরে নানা রাসায়নিক ক্রিয়ার কারণে সব সময় তাপ সৃষ্টি হতে থাকে। ঘামের সাহায্যে সেই তাপ শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যাওয়ায় ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি হয়। ঘামের সঙ্গে লবণ বেরিয়ে যাওয়াতে লবণের ঘাটতি দেখা দেয়। যার ফলে শরীরকে করে তোলে অবসন্ন ও পরিশ্রন্ত। যখন আমাদের শরীর বেশি গরম হয়ে যায় তখন এক পর্যায়ে দেখা যায় আর শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে না।হিট স্ট্রোক হওয়ার আগে শরীরের কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন-তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়।মাথা ব্যথা হয়, দুর্বল লাগে,ঝিমুনি এবং বমি বমি ভাব হয়। এছাড়াও চামড়ার রং লালচে হয়ে যায়।অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, খিঁচুনি হতে পারে এবং হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে যেতে পারে।

হিট স্ট্রোক হলে ততক্ষণাৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে রোগীর মৃত্যু হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।হিট স্ট্রোকে সাধারণত যারা বাচ্চা, বয়স্ক এবং স্থূলকায় মানুষ অর্থাৎ যারা ওবেসিটিতে ভুগছেন খুব সহজেই তাদের হিট স্ট্রোক হয়ে থাকে। 

শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা স্বাস্থ্যকথার আসরে বিশিষ্ট চিকিৎসক আবু কামরান রাহুলের গরমকালের রোগ ব্যাধি নিয়ে আলোচনা শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন। 

রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরলাম আলোচনায়। আচ্ছা ডা. আবু কামরান রাহুল মিউজিক বিরতির আগে আপনি হিট স্ট্রোক সম্পর্কে বলছিলেন। তো হিট স্ট্রোক হলে করণীয় কী?

ডা. আবু কামরান রাহুল: দেখুন যথাসময়ে চিকিৎসা না করলে হিট স্ট্রোকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ফলে বিষয়টিকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ১০০ জন হিট স্ট্রোক রোগীর মধ্যে ৩০ জন রোগী মারা যাচ্ছে। কারও হিট স্ট্রোক হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। তবে হিট স্ট্রোক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির আগে রোগীর জন্য প্রাথমিকভাবে যা করণীয় তা হচেছ:

  • রোগীকে অপেক্ষাকৃত শীতল কোনো স্থানে নিয়ে যেতে হবে
  • ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বা বাতাস করতে হবে।
  • ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে।
  • মুখে যদি রোগী খেতে পারে সেক্ষেত্রে প্রচুর পানি বা খাবার স্যালাইন পান করাতে হবে।
  • কাঁধে-বগলে অথবা কুঁচকিতে বরফ দিতে হবে

তারপর যতদ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসক স্যালাইন দেয়াসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

হিট স্ট্রোক থেকে  প্রতিরোধের উপায়:

গরমের দিনে কিছু নিয়ম মেনে চললে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচা যায়:

● ঢিলেঢালা পোশাক পরুন, হালকা রঙের সুতির কাপড় হলে ভালো

● যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন

● রোদে বাইরে যাওয়ার সময় টুপি, ক্যাপ অথবা ছাতা ব্যবহার করুন

● প্রচুর পরিমাণে পানি বা খাবার স্যালাইন অথবা ফলের রস পান করতে হবে

● রোদে দীর্ঘ সময় ঘোরাঘুরি করবেন না।

● গ্রীষ্মকালে তীব্র শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন।

দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গেলে বেশির ভাগ হিট স্ট্রোকের রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

রেডিও তেহরান: এবার যদি পেটের সমস্যা বিশেষ করে ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, আমাশয় এসব রোগ যাতে না হয় সেজন্য কি করতে হবে। আর হলেই বা করণীয় কি?

ডা. আবু কামরান রাহুল: আসলে গরমকালে তাপমাত্রা অনেক বেশি হয় বলে খাবার দাবার খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আর এসব খাবার খেলে আমাদের ফুড পয়জনিং, ডায়ারিয়া আমাশয় হতে পারে।

এসময় সুস্থ থাকার জন্য যা করতে হবে তা হলো:

১) সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। তাতে করে হাতে লেগে থাকা জীবাণু ধ্বংস হবে। আর হাত যদি জীবাণু যুক্ত থাকে তাহলে সহজেই হাতের জীবাণুর দ্বারা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

২) রাস্তার খোলা খাবার খাওয়া নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দেখা যায় গরমকালে আমাদের দেশে অনেকেই রাস্তায় বিক্রি হওয়া সরবতসহ অন্যান্য খাবার যেমন খোলাপানি, আখের রস, লেবুর সরবত-এসব পান করে থাকেন। এতে কিন্তু আপনি আপনার বিপদ ডেকে আনছেন। কারণ এসব খাবারে টাইফয়েড, জন্ডিস, ডায়ারিয়ার জীবাণু থাকতে পারে। তাছাড়া গরমের সময় ভারী খাবার এবং ফাস্টফুড না খাওয়াই ভালো। তাছাড়া যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে পুরনো এবং বাসি খাবার। আমরা যদি এসব সাবধানতা অবলমন্বন করি তাহলে গরমকালে ডায়ারিয়া, আমাশয় এবং পেট ব্যথাসহ নানা অসুখ বিসুখ থেকে মুক্ত থাকতে পারি।

রেডিও তেহরান: ডা. রাহুল, গরমকালে ত্বকের কি ধরণের সমস্যা হতে পারে? আর ত্বকের সমস্যা থেকে রক্ষায় করণীয় কি?

গরমকালে ত্বকের সমস্যা: ঘামাচি

ডা. আবু কামরান রাহুল: গ্রীষ্মকালে রোদে এবং গরমে আমাদের ত্বকে নানারকমের সমস্যা হয়ে থাকে। তারমধ্যে ঘামাচি একটি অন্যতম সমস্যা। এই ঘামাচি ছোট বড় সবার হয়ে থাকে। তাছাড়া মুখে ব্রন হতে পারে। প্রচণ্ড রোদে দীর্ঘক্ষণ থাকলে সান বার্ন বা রোদে পোড়ার সমস্যা হতে পারে। ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে। আর এরজন্য  মূলত দায়ী ভিজা কাপড়। এসময় ত্বকের এলার্জি সমস্যাও  বেড়ে যায়। সূর্যের আলো থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরে এলার্জি হতে পারে।

তো ডা. আবু কামরান রাহুল, গরমকালের রোগ-ব্যাধি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আর শ্রোতা/পাঠক বন্ধুরা! গরমকালে আপনারা অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। বেশি করে বিশুদ্ধ পানি পান করবেন। পচাঁবাসি খাবার খাবেন না। প্রচণ্ড রোদে বের হবেন না। করোনা কিন্তু এখনও চলে যায় নি-ফলে মাস্ক পরবেন এবং দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন।  পুষ্টিকর ও পরিমিত খাবার খাবেন। আগামী সপ্তায়ও একই বিষয়ে কথা বলব। সে আসরেও আমাদের সঙ্গে থাকতে ভুলবেন না।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩০

ট্যাগ