জুন ০১, ২০২২ ১৬:০৮ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তানে উগ্র সালাফি গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের রহস্য: পর্ব-চার

গত পর্বের আলোচনায় আমরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে উগ্র গোষ্ঠীগুলোকে সৌদি আরবের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। এ ছাড়া, বিভিন্ন কৌশলে উগ্র সালাফি মতবাদ প্রচারে সৌদি আরবের কৌশল নিয়েও কথা বলেছি।

ইরানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক জনাব শাফিয়ি এ ব্যাপারে বলেছেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে বেলুচিস্তানসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে আফগান শরণার্থীদের মধ্যে ব্যাপক কাজ করেছিল সৌদি ওয়াহাবি সালাফিরা। তারা সেখানে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে, অর্থ সহায়তা দিয়ে সালাফি মতবাদের প্রচার চালায়। একই সঙ্গে তারা এসব শরণার্থী ক্যাম্পে সালাফি চিন্তাধারার বই সরবরাহ করে, বক্তব্য দিয়ে, বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিত।

পাকিস্তানে উগ্র ওয়াহাবি সালাফি চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেয়ার কাজে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে এবং এরপর জেনারেল জিয়াউর  রহমানের শাসনামলে ইসলামাবাদ-রিয়াদ সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। সৌদি ওয়াহাবি সালাফিরা ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশে আফগান শরণার্থী শিবিরে মানবিক সাহায্য ও শিক্ষাদান কর্মসূচীর নামে 'আদদাওয়া আল ইসলামিয়া' এবং 'মক্কা আল মোকাররমা আল খেইরিয়া'সহ আরো বেশ কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে যাদের মাধ্যমে অর্থ সহায়তার পাশাপাশি উগ্র সালাফি চিন্তাধারার প্রচার চালাতো। অন্যদিকে, পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকায়ও দেওবন্দ ও ওয়াহাবি মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী। এখানেও সৌদি আরবের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

সৌদি সরকার পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা ও আফগান শরণার্থী শিবিরে দাতব্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও অর্থ সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি আরব ইসলামপন্থীরাও ইসলাম ও কমিউনিজমের মধ্যকার যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য পাকিস্তানে যেত। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আফগানিস্তানের মুজাহিদদের সঙ্গে যোগ দিত। সে সময় খুব অল্প সময়ের মধ্যে আরব যোদ্ধাদের সংখ্যাদের ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

আফগানিস্তানে সাবেক সোভিয়েত  ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরব স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠনে যারা ভূমিকা রেখেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ড: আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযম যিনি কিনা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে লেখাপড়া করেন এবং ইসলামি ফেকাহ বিষয়ে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

ড: আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযম ১৯৮০'র  দশকের  প্রথম দিকে এক ধর্মীয় ফতোয়া জারি করে আফগান যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করাকে ওয়াজিব ঘোষণা কোরে এতে যোগ দেয়ার জন্য সারা বিশ্বের মুসলিম যুবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানের  পেশোয়ার এবং আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুজাহিদদের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য 'মাক্তাব আল খাদামে' নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সেখানে তিনি আর্থিক যোগানের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি তদারকি করেন। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আসা যুবকদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো। আমেরিকাসহ অন্তত ৩৫টি দেশে 'মাক্তাব আল খাদামে'র  শাখা রয়েছে।

আফগানিস্তানের যুদ্ধে বিভিন্ন দেশ থেকে মুজাহিদদের সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আরো যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মিশরের জামায়াত ইসলামি দলের অন্যতম নেতা শেইখ ওমর আব্দুর রহমান। ১৯৮৯ সালে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতে ড: আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযম নিহত হওয়ার পর শেইখ ওমর আব্দুর রহমান মুজাহিদদের আধ্যাত্মিক নেতায় পরিণত হন।

এ ছাড়া, সৌদি আরবের ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনও বিভিন্নভাবে আফগান মুজাহিদদের অর্থ সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি সৌদি আরবের আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করা অবস্থায় আব্দুল্লাহ আজম, হাসানুল বান্না, মওদুদি এবং সাইয়্যেদ কুতুবের মতো বিখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্বদের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয় লাভ করেছিলেন। তাদের জিহাদি চেতনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ত্যাগ করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তানে প্রবেশ করেন। পাক-আফগান সীমান্তবর্তী পেশোয়ারে মুজাহিদদের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত 'মাক্তাব আল খাদামে' নামক প্রতিষ্ঠানে ওসামা বিন লাদেন বিপুল অর্থ দান করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বহু সংখ্যক সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি বড় ভূমিকা রাখেন।

আরব বিশ্বে উগ্র ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত আরেক ব্যক্তি হচ্ছে আইমান আল জাওয়াহেরি। তিনিও ওসামা বিন লাদেনের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক এবং তার পিতা কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন। আইমান আল জাওয়াহেরির দাদা ছিলেন আল আজহার মসজিদের ইমাম এবং তার এক চাচা ছিলেন আরব  লীগ জোটের প্রথম মহাসচিব। আইমান আল জাওয়াহেরির আগমনের পর আল কায়দা গোষ্ঠী চরম উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং প্রকাশ্যেই বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাওয়াজ জার্জেসের মতে আফগানিস্তানের যুদ্ধ তখনই  ইসলামিকরণ ও জিহাদে রূপ নেয় যখন এতে ওয়াহাবি-সালাফি চিন্তাধারার প্রবেশ ঘটে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সামরিক শাখা এতে যোগ দেয়। তার মতে মিশরের উগ্র ইসলামপন্থী গ্রুপের সঙ্গে উগ্র ওয়াহাবি সালাফি চিন্তাধারার মিশ্রণ ঘটায় গত কয়েক দশকে আফগানিস্তানে বিভিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে। অর্থাৎ আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত উগ্রপন্থায় রূপ নেয়। #

পার্সটুডে/এমআরএইচ

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ