জুন ১৮, ২০২২ ১৮:০১ Asia/Dhaka

আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা যুদ্ধের ময়দানে ইরানি শিবিরগুলোর আধ্যাত্মিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পার্থক্য এবং ইরানি যোদ্ধাদের কাছে ইমাম খোমেনীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করব।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব অনেক সুখকর ও দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী। এসব ঘটনার প্রত্যেকটি এই গণবিপ্লবকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। এ ধরনের একটি ঘটনা ছিল ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া আট বছরের যুদ্ধ। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির সহযোগিতায় এ যুদ্ধ শুরু করেছিল সাদ্দাম সরকার। কিন্তু ইরানি জনগণ ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপ্লব ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইরানি বীর যোদ্ধারা প্রায় গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে নিজেদের সামান্য সক্ষমতা নিয়ে দেশ রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন এবং এ যুদ্ধ ইরানি জনগণের কাছে ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি পায়।

আট বছরব্যাপী এ যুদ্ধে ইরানিরা ‘মোকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র’ শব্দ লেখা কাপড়ের ব্যান্ড মাথায় পরে শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আর এখানেই ছিল বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে এই যুদ্ধের পার্থক্য। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে দেশরক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিপ্লব রক্ষা করার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যুদ্ধের লক্ষ্যে পার্থক্য থাকার কারণে যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের আচরণেও ছিল অন্যান্য যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।  বলতে গেলে যুদ্ধের সময় ইরানি শিবিরগুলোতে একটি ভিন্নধর্মী সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ অ্যান্টনি গিডেন্স সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “একটি সমাজের কিংবা একটি সমাজের কিছু মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতিকে সংস্কৃতি বলে।  পোশাক পরিধান, বিবাহের নিয়ম-কানুন, পারিবারিক জীবন, কাজের পরিবেশ, ইবাদত ও ধর্মীয় রীতিনীতি এবং অবসর সময় কাটানোর পদ্ধতি ইত্যাদি সবকিছু সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।”

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর ব্যক্তিত্ব ঘিরে এরকম একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। যখনই যুদ্ধের ময়দানে সৈন্য সংখ্যার ঘাটতি দেখা দিত তখনই ইমামের ছোট একটি বাণী ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার যুবক দিকভ্রান্তের মতো যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যেত। ইমাম খোমেনীর ব্যক্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তিনি ইসলামি শিক্ষার ভিত্তিতে রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতেন। আর জনগণ এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছিল বলে নিজেদের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে ইমামের নির্দেশ পালন করত এবং নিজেদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু অর্থাৎ প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত ছিল। তারা নিজেদের প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু ইমামের নির্দেশ পালন হবে না- এটা মেনে নিতে পারত না। ইরানি জনগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত, ইমাম খোমেনী (রহ.) একজন আধ্যাত্মিক নেতা।

এ কারণে জনগণ সব সময় অধীর আগ্রহে ইমামের বাণী-বক্তব্য শোনা ও তাঁর নির্দেশ পালন করার জন্য অপেক্ষা করত। আরো যেসব কারণে ইরান-ইরাক যুদ্ধ ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ নাম ধারণ করেছিল তা ছিল যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইরানি যোদ্ধাদের উন্নত লক্ষ্য নির্ধারণ। সেই লক্ষ্যটি ছিল দ্বীন ইসলাম ও শিয়া মাজহাবকে রক্ষা করা।  মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত আলাইহিমুস সালামের অনুসারী শিয়া মুসলমানরা ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে সব সময় শাসক শ্রেণির অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের মাধ্যমে শিয়া মাজহাবের অনুসারীরা যে সাফল্য লাভ করেন সেরকম সাফল্য এর আগে তারা কখনো লাভ করেননি। এই বিপ্লবের মাধ্যমে তারা তাদের শোষণ-বিরোধী ও ন্যায়বিচারকামী স্লোগান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। এ কারণে তারা যুদ্ধের সময় একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, এই যুদ্ধে তাদের জীবন চলে গেলেও তারা চূড়ান্ত সফলকাম।   

ইরানি যোদ্ধারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, যদি তারা দেশ ও বিপ্লব রক্ষার জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দিতে পারেন তাহলে তারা মহাসাফল্য অর্জন করবেন। কারণ, এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দ্বীন, কুরআনে কারিম ও বিশ্বনবীর আহলে বাইতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের জীবন বিসর্জিত হবে। তারা আরো বিশ্বাস করতেন তাদের প্রতি ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ার মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম নামক বৃক্ষটি শক্তিশালী হবে। তারা যখন যুদ্ধের ময়দানে সাদ্দাম বাহিনীকে বড় ধরনের পরাজয়ের স্বাদ দিতে পারতেন তখন তারা এই বিজয়কে আল্লাহ-প্রদত্ত বলে মনে করতেন। এই উন্নত বিশ্বাসের কারণে যুদ্ধের ময়দানে ইরানি শিবিরগুলোতে সব সময় আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করত।

আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে যদিও ইরাক ইরানের চেয়ে ছোট ছিল তবু সামরিক দিক দিয়ে ইরাকের শক্তি ছিল অনেক বেশি। কারণ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রায় ৫৬টি দেশ বাগদাদ সরকারের প্রতি অর্থনৈতিক, সামরিক, গোয়েন্দা ও রাজনৈতিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের আট বছরে বহুবার এমনটি হয়েছে যে, ইরাকি বাহিনী ইরানের হাতে বড় ধরনের পরাজয় বরণ করার পরও আগের চেয়ে আরো বেশি শক্তি সঞ্চয় করেছে।  কারণ, সাদ্দাম বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বা একটি ট্যাংক কিংবা একটি জঙ্গিবিমান ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দশ বা বিশ গুণ বেশি সমরাস্ত্র বাগদাদের হাতে তুলে দেয়া হতো। অথচ যুদ্ধের সময় ইরানের ওপর এত বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয় যে, তেহরানের পক্ষে সামান্য তারকাঁটা সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক এ কারণেই ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরান-ইরাক যুদ্ধকে ইসলাম ও কুফরের যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছিলেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ