রংধনু আসর
মসনবীর গল্প: বৃদ্ধ রোগী ও ডাক্তার
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। প্রত্যেক আসরের মতো আজও তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, রংধনুর আজকের আসরের প্রথমেই রয়েছে একটি গল্প। এটি নেওয়া হয়েছে প্রখ্যাত ইরানি কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমির মসনবী গ্রন্থ থেকে। গল্পের পর থাকবে একটি গান। আর সবশেষে থাকবে বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।
এক বৃদ্ধলোক নানা রোগ-শোক নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারের চিকিৎসায় হয়তো তার রোগের উপশম হবে, কয়েকদিন শান্তিতে কাটানো যাবে- এমন আশা নিয়ে তিনি ডাক্তারকে বললেন, ডাক্তার মশাই! দয়া করে একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বড় অসহায় অবস্থায় আপনার কাছে এসেছি।
ডাক্তার বললেন: কী হয়েছে আপনার বলুন।
বৃদ্ধ বললেন: আমার মাথা কাজ করছে না। জানি না মস্তিষ্ক নষ্ট হয়ে গেল কি-না। কিছুই মনে থাকে না। বড় যন্ত্রণাদায়ক। এর চিকিৎসা দয়া করে আগে করুন।
ডাক্তার: আপনার এই অসুবিধা বার্ধ্যক্যের কারণে। এমন অবস্থা আপনার মতো লোকদের হওয়া স্বাভাবিক।
বৃদ্ধ: দেখুন, আমি চোখেও ভালোভাবে দেখি না। শুধুই ঝাপসা দেখি।
ডাক্তার: হ্যাঁ, তা তো হবেই। বার্ধক্যের এ প্রভাব আপনাকে মানতে হবে।
বৃদ্ধ: আমার কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। চলাফেরা বড়ই কষ্ট হচ্ছে। ওষুধ দিন ডাক্তার।
ডাক্তার: বার্ধক্যের কারণে এমনটি হচ্ছে চাচা।
বৃদ্ধ: আমি বেছে বেছে খাই। এরপরও হজম হয় না। বড় কষ্টে আছি।
ডাক্তার: মানুষ বার্ধক্যে পৌঁছলে এমনটি হবেই। উপায় নেই। পরিপাকতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়। সহজে হজম হয় না।
বৃদ্ধ: ডাক্তার! প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। দম বন্ধ হয়ে আসে। কোনো ওষুধ দেবেন না?
ডাক্তার: বৃদ্ধ হলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা তো হবেই, এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।
ডাক্তারের কথায় রাগে, অপমানে বৃদ্ধের বুকটা ফেটে গেল। প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে বলে উঠল: আহম্মক! কে বলেছে তুমি ডাক্তার। বাপের পয়সা হারাম করেছ। এত বছরে ডাক্তারির কচু শিখেছ! শুধু বলতে শিখেছ, সব রোগ-শোকের জন্য বার্ধক্য দায়ী। এ একটি কথার জন্য ডাক্তারিবিদ্যায় ঘাস কাটতে গিয়েছিলে?
ডাক্তার জবাব দিলেন: চাচা, এই যে রেগে গেলেন, এটাও তো বার্ধক্যের কারণে। মানুষ যখন বুড়ো হয়, দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন অল্পতে রেগে যায়। দুই কথা শোনার ধৈর্য হয় না। সামান্যতে চিৎকার চেঁচাম্যাচি করে। শুধু বুড়ো লোক নয়, বা বুড়া হওয়া শর্ত নয়, যাদের মানসিকতায় বার্ধক্য জমে আছে, কিংবা বার্ধক্যের উপসর্গ যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তাদের অবস্থাও এমনই।
বন্ধুরা, ডাক্তারের কথা শুনে তোমাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে- সব বৃদ্ধ একই রকম? তোমাদের এ প্রশ্নের জবাবে মাওলানা রুমি (রহ.) বলেছেন:
যে বৃদ্ধ আল্লাহর হয়ে মস্ত মাতাল
তার ভেতরে পবিত্র জীবনের বসন্তকাল।
বাইরে সে বৃদ্ধ; কিন্তু ভেতরে তরুণ যুবক
কী বলব, সে-ই অলি, সে নবীর আসল রূপ।
বন্ধুরা, বাংলা 'বৃদ্ধ' মানে ফারসিতে 'পীর'। আমাদের দেশে 'পীর' শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে। যারা জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত তথ্যাদির পরিপক্বতায় পৌঁছে, তাদেরকেই 'পীর' বলা হয়। আমাদের কাছে পীর আধ্যাত্মিক সাধকদের বিশেষ শ্রেণির পরিচয়বাহী পরিভাষা। সাধারণ পরিপক্ব লোক ও সম্মানীয় বলতে আমরা মুরব্বি বলে থাকি। এটি এসেছে আরবি থেকে; তবে ইরান হয়ে। আরবিতে পীরের প্রতিশব্দ হতে পারে শায়খ। পুরোনো উচ্চারণে শেখ।
মাওলানা রুমি আধ্যাত্মিক পুরুষ অর্থে পীরের যে পরিচয়, তার দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, প্রকৃত পীরেরা খোদায়ি পবিত্র জীবন প্রণালি নিয়ে মস্ত মাতাল। যারা মারেফাতের ঢেউ তরঙ্গে হাবুডুবু খায়, তারা দৃশ্যত বুড়ো মানুষ। কিন্তু অন্তর্গতভাবে তাদের জীবনে নিত্যবসন্ত। তারা দেখতে বুড়ো বা পীর মনে হলেও তাদের ভেতরে হাজারো বসন্তের ফল্গুধারা।
বন্ধুরা, তোমরা যদি জীবনকে চিরযৌবনদীপ্ত করতে চাও তাহলে অন্তর্জগতকে আলোকিত করতে হবে এবং সব আবর্জনা ও আবিলতা থেকে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ভালো ও উন্নত চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু আসতে দেবে না তোমাদের মনে।
বন্ধুরা, তোমরা সবাই জানো যে, জ্ঞানই শক্তি। কিন্তু যৌবনের শক্তিও যে জ্ঞানের মধ্যে নিহিত তা আমরা জানতে পারি ইরানের আরেকজন মহাকবির কাছ থেকে। ইরানের জাতীয় কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী তার মহাকাব্য শাহনামার ছোট্ট একটি শ্লোকে লিখেছেন-
শক্তিমান সে ব্যক্তি যে হয় জ্ঞানবান
জ্ঞানের কারণে যৌবনদীপ্ত বৃদ্ধের প্রাণ।
মহাকবি ফেরদৌসীর মূল্যায়ন হচ্ছে- মানুষের শক্তির উৎস জ্ঞান। জ্ঞানের মধ্যেই তার চিরতারুণ্যের রহস্য লুকিয়ে থাকে। মওলানা রুমি (রহ.)-এর কাছে এই তারুণ্যের তাৎপর্য আরও গভীরে, আরও ব্যাপক। তার মতে, জগতে যত নবী-রাসুল (আ.) ও আউলিয়ায়ে কেরাম এসেছেন, আল্লাহর জ্ঞান ও পবিত্র জীবনের সুবাদে তারা চিরতরুণ ছিলেন। তাদের জীবনে ছিল হাজারো বসন্তের সমারোহ। তারুণ্যের সেই ফল্গুধারায় তারা দুনিয়ার চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
কাজেই আমাদের উচিত সৎ, সুন্দর, উন্নত চিন্তাধারায় নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ বলেন- ‘মোমিন অবস্থায় পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম সম্পাদন করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’ (সূরা নাহল : আয়াত-৯৭)।
বন্ধুরা, এ পর্যায়ে রয়েছে একটি গান। গানটি গেয়েছে সিলেটের দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর শিশু শিল্পীরা।
এবারের রয়েছে বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার।

তো ছোট্টবন্ধুরা, দেখতে দেখতে আমাদের সকল আয়োজন এক এক করে শেষ হয়ে এল। তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।