ইরান ভ্রমণ : (পর্ব-১২২)
বজনুর্দ শহর ও প্রাকৃতিক নিদর্শন
আমরা ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উত্তর খোরাসান প্রদেশে বেড়াচ্ছি। উত্তর খোরাসান প্রদেশের মূল শহরের নাম বোজনুর্দ। গত আসরে আমরা বজনুর্দ্ শহরের কয়েকটি প্রাকৃতিক নিদর্শনের সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি।
আমান পার্ক বা অবকাশ যাপনকেন্দ্রের পাশাপাশি এখানকার একটি কবরও দেখেছি আমরা। ইমাম মূসা কাজেম (আ) এর সন্তান শাহজাদা ইসমায়িলের এই কবরটি ইমামযাদা বাবা আমান নামেই বিখ্যাত।
এই সুন্দর পার্ক ঘিরেই গড়ে উঠেছে অবকাশ যাপন কেন্দ্র। বাবা আমান বিনোদন পার্কের পশ্চিমে রয়েছে পারদিসান বনাঞ্চল। এখানে উত্তর খোরাসানের গাছপালা এবং প্রাণীর বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। বাবা আমান অবকাশ যাপন কেন্দ্রটি বজনুর্দের দশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বজনুর্দ-মাশহাদ সড়কের পাশে অবস্থিত। বন,উদ্যান এবং দর্শনীয় পুলসহ এই প্রমোদ কাননটি ক্লান্তি দূর করার জন্য বেশ উপযোগী। সে কারণে অনেক ভ্রমণকারী এই কাননের প্রতি ভীষণ আকর্ষণ বোধ করে এবং অতীতেও করেছে। বাবা আমানে চমৎকার একটি ঝরনা রয়েছে। এই ঝরনাটি পাথরের বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে। এখানকার পানি সুইমিং পুলগুলিতে প্রবাহিত হয়। বাবা আমানের আবহাওয়া খুবই উপভোগ্য। রাতের বেলা এখানকার মনোরম ও সুন্দর দৃশ্য প্রতিটি পর্যটককেই আকৃষ্ট করে।
বজনোর্দ অঞ্চলের আশেপাশে দেখার মতো আকর্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। বজনোর্দ শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে আলিয়াবাদ নামে একটি গ্রাম রয়েছে। ওই গ্রামটিকে উত্তর খোরাসান প্রদেশের ইরানি বাগানের অন্যতম সেরা নিদর্শন বলে মনে করা হয়। এই বাগানটির একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে একটি ভিলা। ইরানে ভিলাময় চারটি বাগানের একটি হলো এই আলিয়াবাদ। দুই শ বছরেরও বেশি পুরানো এই ভিলাময় গ্রামটি। ভিলাটি শদলোর শাসকদের নির্মিত বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ভিলার একটি বৈশিষ্ট্য হলো সবদিকেই একটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। ভিলার মূল পরিকল্পনায় নিচতলায় ঠিক কেন্দ্রস্থলে একটি গম্বুজযুক্ত ছাদসহ পানির হাউস রয়েছে। ওই পানির হাউসের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে দুটি কক্ষ রয়েছে।
কাজার শাসনামলে বোজনুর্দের শাসক সর্দার মোফাখখামের আমলে এই বাগানটিকে একটি বিনোদন পার্ক হিসেবে যেমন ব্যবহার করা হতো তেমনি শিকারের জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল তখন। কিন্তু এখন এটি বোজনুর্দের একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবেই পরিগণিত। এই ঐতিহাসিক স্থাপনার শুধুমাত্র কাঠামোর স্মৃতিটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে। যার ফলে এটিকে এখন একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবেই মর্যাদা দেওয়া হয়।
বন্ধুরা আপনারা যারা আমাদের রেডিওর ইরান ভ্রমণ অনুষ্ঠানটি নিয়মিত শোনেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে ইরানের প্রতিটি অঞ্চলেই রয়েছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় হস্তশিল্প সামগ্রী এবং খাবার দাবার। বোজনুর্দেরও এরকম ভীষণ জনপ্রিয় কিছু উপহার সামগ্রী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আমরা উল্লেখ করতে পারি পনির ক্যান্ডির কথা। এগুলো পণিরের সঙ্গে চিনির সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়। যেসব উপাদান এই পণির ক্যান্ডিতে ব্যবহার করা হয় সেসবের মধ্যে উল্লেখ করার মতো হলো এলাচ, যেরেশ্ক, নারকেল, জাফরান, লেবু, পেস্তা, দারচিনি, আদা, তিল, কোকো ইত্যাদি। প্রায় আশি বছর ধরে এগুলো উত্পাদিত হচ্ছে।
বোজনুর্দের অপরাপর উপহার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে: বিশেষ দই, পীচ, আপেল, আমসত্ত্বের মতো বিভিন্ন রকমের ফলের সত্ত্ব, শুষ্ক বাদাম, কিশমিশ এবং বীচি-বাদাম, কুর্দি টেবিলক্লথ-এগুলো জ্যামিতিক নকশাসহ, প্রাণী ও উদ্ভিদের নকশাময়, স্থানীয় পোশাক-আশাক, দ্বিমুখি কার্পেট মানে কার্পেট উল্টিয়ে দিলেও আরেকটি ডিজাইন পাওয়া যায়-এরকম চার ঋতুর ডিজাইনে করা হয়, গেলিম-এটিও এক ধরনের কার্পেটের মতোই, চরোক দুজি বা এক ধরনের সূচিকর্ম-সাধারণত চামড়ার সামগ্রির ওপর রঙীন সূতোর কারুকাজ, এগুলো হাতেই করা হয়, পশমি সূচিকর্ম, উচ্চ মানের তুরকামানি কার্পেট, স্থানীয় তুরকামান অলঙ্কার, জামাকাপড়, তুলতুলে টুপি, জাজিম, ঐতিহ্যবাহী টেক্সটাইল বয়ন ইত্যাদি।
বোজনুর্দের সবচেয়ে বিখ্যাত বাজারটি ইমাম রেজা ডেইলি বাজার নামেই পরিচিত। এই বাজার থেকে স্থানীয় উপহার সামগ্রী ছাড়াও কৃষি পণ্য, গৃহজাত পণ্য, বিচিত্র হস্তশিল্প এবং কাপড়-চোপড় ইত্যাদি কিনতে পারা যাবে।
আসর থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বোজনুর্দের আরও কিছু তথ্য দেওয়া অসমীচিন হবে না বলে মনে করি। মধ্যযুগে বোজনুর্দের নাম ছিল বুজানজির্দ। এটি ছিল রাজধানী শহর। ইরানের উত্তর খোরাসান প্রদেশের এই শহরটির দূরত্ব ইরানের রাজধানী শহর তেহরান থেকে প্রায় চার শ ছত্রিশ মাইল। প্রাচীন শহরটি বর্তমান বোজনুর্দ শহরের উত্তর-পশ্চিমে একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল। স্থানীয় লোকেরা সারবান মাহলেহ নামে অভিহিত করতো।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।