জুলাই ২১, ২০২২ ১৮:৫৫ Asia/Dhaka

আমরা নিজেকে চেনা ও জানার প্রয়োজনীয়তা ও উপায় নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি গত আসরে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা নিজেকে চেনা ও জানার বিভিন্ন ধাপ বা স্তর নিয়ে কথা বলব।

অধিকাংশ চিন্তাবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদের মতে নিজেকে চেনা বা জানার কয়েকটি ধাপ বা স্তর রয়েছে। এর সবগুলোই মনস্তাত্ত্বিক স্তর। মনের দিক থেকে একেক ব্যক্তি একেক স্তরে অবস্থান করে থাকে। নিজেকে চেনা বা জানার প্রথম ধাপটি হলো, ইগো-পেরেন্ট। এই ধাপটি হলো এমন যে, এই পযায়ে আমরা আমাদের জীবনে কেবল তখনি আনন্দ পাই যখন আমাদের বাবা-মা সন্তুষ্ট হন। অর্থাৎ বাবা-মা আমাদেরকে শাস্তি দিলে আমাদের মন খারাপ হয় এবং তারা খুশি হলে ও উৎসাহ দিলে আমরা খুশি হই। হয়তো আপনি ভাবছেন যে, এই ধাপটি কেবল শৈশবের জন্য প্রযোজ্য। আসলে এমন নয়। এই পর্যায়টি বয়সের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। কারণ এমন অনেকেই আছেন যারা বড় হয়ে এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই স্তরেই রয়ে যান। এ থেকে বেরুতে পারেন না।

দ্বিতীয় ধাপ বা স্তরটি হলো-ইগো-ওয়ার্ল্ড। এই পর্যায়ে আমাদের চেষ্টা থাকে বিশ্বের কাছে অর্থাৎ বাইরের  জগতের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার। এই ধাপে বন্ধুমহল এবং পরিবারের বাইরের লোকজনের সন্তুষ্টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ধাপে মানুষ অন্যের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে গিয়ে অসামাজিক ও বেআইনি কাজও করে ফেলতে পারে। আসলে এ স্তরে থাকা ব্যক্তি অন্যের দৃষ্টিআকর্ষণ করাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে থাকে এই স্তরে থাকা মানুষেরা। নিজেকে চেনা-জানার ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে- ইগো-সেল্ফ। মানুষের বিকাশলাভ ও আত্মপরিচিতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ধাপ হচ্ছে এটি। এই স্তরে থাকার অর্থ  হলো আমরা নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। নিজের প্রতি আকর্ষণও সৃষ্টি হয় এই ধাপে। এই স্তরে আমরা কেবল নিজের সঙ্গেই নিজে প্রতিযোগিতা করি। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ এই স্তরের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না।

ইগো সেল্ফ স্তরে আমরা পরিবার বা বাইরের মানুষের কাছে নয় বরং নিজেকে নিজের কাছেই প্রমাণ করতে চাই। এই স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারলে আমরা বুঝতে পারি, অতীতের অনেক আচরণ ও কাজই ছিল ভুল এবং অন্যকে খুশি করার সেগুলো করা উচিত হয়নি। এটাও বুঝতে পারি যে, অতীত আচরণ নিজের জন্য ক্ষতিকর ছিল। এ কারণে এই স্তরে উত্তীর্ণ ব্যক্তিরা অতীতের অনেক অভ্যাসই বর্জন করেন। একইসঙ্গে আমরা এমন সব কাজে বেশি মনোযোগী হন যা নিজের অন্তরান্তা থেকে অনুমোদিত মনে হয়, অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করা এখানে লক্ষ্য থাকে না। এই ধাপে এসে ব্যক্তি তার পেশা ও অবস্থানও পাল্টে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে এবং পেশা পরিবর্তন করে নতুন পেশা বাছাই করতে পারে। কারণ এই স্তরের ব্যক্তিরা এমন কাজের দিকে মনোযোগী হন যা প্রথম থেকেই তার কাছে ছিল আকাঙিক্ষত এবং এমন কাজ করেন যা তাকে আনন্দিত করে।

নিজেকে চেনা ও জানার সর্বশেষ ধাপ বা স্তরটি হলো ইগো-গড। এই পর্যায়ের মানুষ ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার উর্ধ্বে উঠে যায়। এই স্তরে ব্যক্তির কাছে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে তাহলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আমরা যদি এটা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহই হচ্ছেন সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এই প্রচেষ্টা অর্থবহ হয়ে ওঠে। এই ধাপে মানুষ তার সীমাবদ্ধতা উৎরে অসীম অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। এই স্তরে একজন ব্যক্তি বুঝতে  পারে  যে, অসীম অস্তিত্বের সামনে মানুষের সসীম অস্তিত্ব একেবারেই তুচ্ছ। এই পর্যায়ে এসে মানুষ প্রকৃত ভালোবাসা, আনন্দ ও সন্তুষ্টির মর্মার্থ বুঝতে পারে ভালোভাবে। এই ধাপে উত্তীর্ণ মানুষ তার জীবন ও অবস্থান নিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে না। যারা এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন তারা আত্মদ্বন্দ্ব থেকে যেমন মুক্তি পান তেমনি অন্যের সঙ্গে সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হয়। সব মিলিয়ে নিজেকে চেনা ও জানার মাধ্যমে আমরা আগের চেয়ে আরও বেশি সুখী হতে পারি।

'সেল্ফ নলেজ' বইয়ের লেখক এলন দু বুতুন মনে করেন, কেউ যদি নিজেকে সঠিকভাবে চিনতে না পারে তাহলে সে নানা সমস্যায় পতিত হবে। তার মধ্যে ভুল প্রত্যাশার জন্ম নেবে। আত্মজ্ঞানের অভাবে নিজের মধ্যে অনিরাপত্তার অনুভূতির জন্ম নেবে এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েব। নিজেকে চিনতে না পারার কারণে একজন সহজেই বিদ্যমান পরিস্থিতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে পড়বে। খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করা এ ধরণের ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কও তখন অকারণে জটিল হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় আমরা এমন পেশা বা কাজ বেছে নেব যা আমাদের জন্য উপযুক্ত নয় অথবা না বুঝেই ক্ষমতালোভী হয়ে উঠব আমরা। আমরা যখন নিজেকে চিনতে না পারার নেতিবাচক প্রভাবের দিকে তাকাই তখন এর প্রয়োজনীয় আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারি।

আপনি যখন নিজেকে চিনতে পারেন তখন আপনি সমাজে নিজেকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন এর ফলে আপনি আনন্দিতবোধ করেন। নিজের ভালো লাগার বিষয়গুলো যখন প্রকাশ করতে পারেন তখন তা প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আত্মদ্বন্দ্ব কমতে শুরু করে। আপনি যখন কোনো পদক্ষেপ নেন তা আপনার ভেতরের অনুভূতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এর ফলে ভেতরের দ্বন্দ্ব কম ঘটে। নিজেকে চেনার পর যেকোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়, তুলনামূলক সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। একটা শার্ট কেনার মতো ছোটখাটো সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের মতো বড় সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সব কিছুতেই তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয় নিজেকে চিনতে পারলে। নিজের সঙ্গে চেনা ও জানার গভীরতা যত বেশি হয় তত ভালোভাবে নিজের অভ্যাসগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। খারাপ অভ্যাসগুলো বাদ দিয়ে সুঅভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিজেকে চেনার গুরুত্ব অপরিসীম।

আপনি নিজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ভালো-মন্দ দিক জানার পর আপনি আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক চাপ বা অন্যেরা কী ভাবছে-এমন চিন্তায় মশগুল না থেকে আপনি তখন দৃঢ়ভাবে সঠিক পথে চলার শক্তি পাবেন অনেক বেশি। আপনি  যখন আপনার মূল্যবোধগুলো ভালোভাবে চিনবেন তখন অন্যকে এসবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেকোনো বিষয়ে সহজেই 'না' বলে দিতে পারবেন। নিজেকে চেনার মাধ্যমে নিজের দুর্বল দিক ও সমস্যাগুলো নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর ফলে আপনি অন্যদের সমস্যা ও দুর্বলতা ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং অন্যদের প্রতি সহমর্মী হতে পারেন। সব মিলিয়ে আপনি নতুন ধরণের অফুরন্ত স্বাদ ও আনন্দের নাগাল পান। নিজেকে না চিনলে কখনোই তা পাওয়া যায় না।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/আবুসাঈদ/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ