জুলাই ২৭, ২০২২ ১৮:৪১ Asia/Dhaka

আজকের আসরে আমরা ইরানের অকুতোভয় যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর গভীর আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলব।

বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধের একটি অনন্য পার্থক্য ছিল ইরানি যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)’র গভীর আত্মিক সম্পর্ক। ইমামের যদি সেই আধ্যাত্মিক শক্তি না থাকত এবং তিনি যদি ইরানি তরুণদের অন্তরে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে না পারতেন তাহলে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ী হতো না বা বিজয়ী হলেও পরবর্তীতে এই বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য যে অসংখ্য ষড়যন্ত্র হয়েছে তার মোকাবিলায় বিপ্লব টিকে থাকতে পারত না। ইসলামি বিপ্লব ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র ছিল ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দামের মাধ্যমে ইরানের ওপর আট বছরের যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া। ওই যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস ছিল ইমাম খোমেনীর বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও আধ্যাত্মিক গুণাবলী।  বহু ইরানি যোদ্ধা শুধুমাত্র ইমামের উজ্জ্বল ও নূরানি চেহারার কথা স্মরণ করে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আবার অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল ইমামের আন্তরিক ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী ভাষণ।

ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি ইমামের ভালোবাসা এতটা গভীর ছিল যে, তিনি একবার বাসিজ বা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর জওয়ানদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন: “আমি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে চাই যে, তিনি যেন আমাকে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শহীদদের সঙ্গে হাশর-নাশর করেন। ” ইরানি যোদ্ধাদের সঙ্গে ইমাম খোমেনীর আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক বই ও আত্মজীবনী লেখা হয়েছে।  এসব বই ও আত্মজীবনীর সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না।  আমরা আজ বাছাই করা কয়েকজনের স্মৃতিকথা তুলে ধরার চেষ্টা করব।  ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর দপ্তরের কর্মকর্তা জনাব রাহিমিয়ান নিজের আত্মজীবনীতে ইমাম সম্পর্কে লিখেছেন: যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছুটিতে আসা এক যোদ্ধা ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের কাছে ইমামের একটি ছবি নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, আমি এই ছবিটির অসংখ্য কপি তৈরি করে ফ্রন্টের যোদ্ধাদের মাঝে বিলি করতে চাই। আপনি ইমামকে অনুরোধ করুন তিনি যেন তার এই ছবির উপর নিজের হাতে কিছু বাণী লিখে দেন।

তার অনুরোধ শুনে আমার কাছে মনে হয়েছিল, ইমামের কাছে ছবিটি নিয়ে গেলে তিনি নিজের অটোগ্রাফ ছাড়া আর কিছু তাতে লিখবেন না।  কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমাণ করে দেন ইমাম। তাঁর কাছে গিয়ে ইরানি যোদ্ধার অনুরোধটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাতে কলম তুলে নেন। তিনি ওই ছবির পাশে যে কথাগুলো লেখেন তা ছিল এরকম: “বিসমিহি তায়ালা। আমি মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রাণপ্রিয় যোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় কামনা করছি। প্রিয় যোদ্ধারা! আপনারা লড়াই করুন আল্লাহ আপনাদের সঙ্গে আছেন। আমি আপনাদের সকলের হাত ও বাহুতে চুমু খাচ্ছি। ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। রুহুল্লাহ আল মুসাভি আল খোমেনী।”

ইরান-ইরাক যুদ্ধের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সেনা কমান্ডার লে. জেনারেল শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি তাঁর আত্মজীবনীতে ইমাম খোমেনী সম্পর্কে লিখেছেন: “একবার ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে ইরাকের বিরুদ্ধে ওয়ালফাজর-২ অভিযানে বিজয়ের পর আমরা ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। ওই অভিযানে অংশগ্রহণকারী বেশ কিছু কমান্ডার ও যোদ্ধাকে ইমাম সাক্ষাতের সুযোগ দিয়েছিলেন। তেহরানের অদূরে জামারানে ইমামের বসার ঘরের কক্ষটি ছিল অত্যন্ত ছোট। সেখানে কয়েকজনের বেশি লোক একসঙ্গে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারত না। আমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে কয়েকজন করে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে আসছিলাম এবং এরপর আরেক দল তার কক্ষে ঢুকছিল।  সাক্ষাতের এক পর্যায়ে মুর্তজা জাভিদি নামের এক যোদ্ধাকে তার সাহসিকতার জন্য ইমামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

জাভিদি তখন পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ইমামের কপাল, মুখমণ্ডল ও হাতে চুমু খেতে থাকে। কিছুটা শান্ত হওয়ার পর সে ইমামের পায়ের কাছে বসে পড়ে। এরপরের দৃশ্যটি আমি আজও ভুলতে পারি না। ইমাম বয়সের ভারে ন্যুব্জ তার ওই দীর্ঘকায় শরীর বাঁকা করে সাহসী যোদ্ধা জাভিদির কপাল টেনে ধরে চুমু খান। আমি সেদিন ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি ইমামের ভালোবাসার গভীরতা ও আন্তরিকতা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছিলাম। ”

এখানে বলে রাখা প্রয়োজ মুর্তজা জাভিদি ১৯৮৬ সালে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শালামচে এলাকায় আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অভিযানে শহীদ হন। এছাড়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার ১১ বছর পর ১৯৯৯ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পিপলস মুজাহেদিনের হামলায় লে. জেনারেল সাইয়্যাদ শিরাজি শাহাদাতবরণ করেন।

ইরানের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখক ও শিক্ষাবিদ গোলামআলী রাজায়ি ইরানি যোদ্ধাদের সঙ্গে ইমাম ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর গভীর আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। তিনি এক বইয়ে লিখেছেন: “আমরা ইরাকের বিরুদ্ধে ফাতহুল মুবিন অভিযানে বিজয়ী হওয়ার পর ইমামের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়। আমরা অভিযানে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদেরকে ওই যুদ্ধের ধুলিমাখা পোশাক ও হেলমেট পরা অবস্থায়ই একটি ট্রেনে করে তেহরানে ইমামের কাছে নিয়ে আসি। ইমাম জামারান হোসেইনিয়ার বিশাল হলরুমে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাকে এক নজর দেখতে পেয়ে যোদ্ধাদের চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে এবং অনেককে উচ্চস্বরে কাঁদতে দেখা যায়। ভাষণের একাংশে ইমাম বলেন: “আপনাদের মতো বীর যোদ্ধারা যে বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন আমিও সেই বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।” যোদ্ধাদের প্রতি বিনয় প্রকাশকারী ইমামের এই বক্তব্য শুনে উপস্থিত সবার মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ