তুরস্কের মাটিতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলি ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক মাস আগে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় আসতে পারবে না তখন তিনি ও হোয়াইট হাউজে তার উগ্রপন্থী নেতা-কর্মকর্তারা নির্বাচনে জেতার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
নির্বাচনে জেতার জন্য তারা মার্কিন ইহুদিবাদী লবিং গ্রুপকে খুশি করতে কয়েকটি আরব দেশের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালান যাতে এ অঞ্চলে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং এটাকে ট্রাম্পের অবদান হিসেবে তুলে ধরা যায়।
ছোট ছোট আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য মাধ্যম হিসেবে সৌদি আরবকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কেননা এ দেশগুলো সৌদি আরবের কথায় উঠবস করে। এ ছাড়া, আরব দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধও উস্কে দেয়ার চেষ্টা চলছে যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে এবং তাদের ওপর কোনো নীতি বা পরিকল্পনা চাপিয়ে দেয়া যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব ও তুরস্ক সরকার মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং শত্রুতা ও বিদ্বেষ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে, ইসরাইলের সাথে তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ । সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তুরস্ক সফরে যান এবং প্রায় একই সময়ে ইসরাইলের বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদও তুরস্ক সফর করেন। সৌদি ও ইসরাইলি নেতাদের তুরস্ক সফর ছিল পূর্ব পরিকল্পিত এবং এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা। ইসরাইলের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি তুরস্ককে ইরান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। অর্থাৎ ইসরাইলের সাথে এই দেশগুলোর সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ইরান বিরোধী আবহ তৈরি করা।
সম্প্রতি ইরান বিরোধী প্রচার প্রোপাগান্ডা তৈরিতে ইহুদিবাদী ইসরাইল বিশেষ করে তাদের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। মোসাদ সম্প্রতি এ প্রচারণা চালিয়েছে যে ইরান তুরস্কে অবস্থিত ইসরাইলি নাগরিকদের টার্গেট করে তাদেরকে অপহরণ করছে অথবা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। প্রায় দুই মাস আগে তারা অনেক বড় পরিকল্পনার আওতায় ইরান বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে মানসুর রাসুলি নামে এক ব্যক্তির নামে একটি ভুয়া অডিও বার্তা প্রচার কোরে তারা দাবি করেছে যে, এই ব্যক্তি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির পক্ষ থেকে তুরস্কে ইসরাইলি দূতাবাসে একজন ইসরাইলি নাগরিককে, জার্মানিতে এক মার্কিন জেনারেলকে এবং ফ্রান্সে এক সাংবাদিককে হত্যা করেছে। মোসাদ এমন সময় ইরান বিরোধী এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে যখন ইসরাইলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ইউরোপ পরমাণু সমঝোতায় মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে, আইআরজিসির কুদস ব্রিগেডকে মার্কিন সন্ত্রাসীদের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে, ইসরাইল ও আমেরিকা আরব দেশগুলোকে তেলআবিবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরান বিরোধী কথিত সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা চলছে।
ইরান বিরোধী প্রচার প্রোপাগান্ডার পেছনে মোসাদের তিনটি বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, সন্ত্রাসীদের তালিকা থেকে আইআরজিসির কুদস ব্রিগেডকে বাদ দেয়ার জন্য বাইডেন প্রশাসনের সম্ভাব্য চেষ্টা রুখে দেয়া। দ্বিতীয়ত, পরমাণু সমঝোতা পুনরুজ্জীবনের আন্তর্জাতিক চেষ্টাকে বানচাল করা এবং তৃতীয়ত, যে কোনো উপায়ে এ ক্ষেত্রে ইউরোপের মধ্যস্থতার চেষ্টা রুখে দেয়া। এ ছাড়া মোসাদের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরানের ভয় দেখিয়ে তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে আরো জোরদার করা এবং তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোও অন্ধভাবে এবং কোনো যাচাই না করেই ইসরাইলের দেয়া ইরান বিরোধী এ সংক্রান্ত বানোয়াট ও মিথ্যা খবরাখবর প্রচার করছে। তারাও এসব খবরকে সত্য বলে তুলে ধরার চেষ্টায় লিপ্ত। অথচ মানসুর রাসুলির নামে ভুয়া অডিও বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি নিজেই স্বীকার করেছে যে সে কৃষি খামারে কাজ করে এবং কিছু দিন আগে কে বা কারা তাকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তার ওপর অনেক শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং তাকে ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করে।
ইরানের বিরুদ্ধে ভুয়া অডিও প্রকাশের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ এ নিয়ে হৈ চৈ বন্ধ থাকে। কেননা সে সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইসরাইলের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদের তুরস্ক সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরপর মোসাদ ও পাশ্চাত্যের মিডিয়া ওই বিষয়ে ইরান বিরোধী প্রচারণা বন্ধ রাখে এ কারণে যে তেলআবিবের দুটি উদ্দেশ্য অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে পরমাণু সমঝোতা থেকে বিরত রাখা এবং ইরানের কুদস ব্রিগেডকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা ঠেকাতে সফল হয় ইসরাইল। কিন্তু যেহেতু আপোষকামী আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এবং ইরান বিরোধী আঞ্চলিক জোট গঠনের চেষ্টা এখনো সফল হয়নি সে কারণে তারা ইরান বিরোধী প্রচারণার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে।
এবার তাদের প্রচারণার কেন্দ্র হচ্ছে তুরস্ক। ইসরাইলের বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদের তুরস্ক সফরের কয়েকদিন আগে ইসরাইলের কয়েকটি সূত্র দাবি করেছিল, 'ইরান তুরস্কে অবস্থিত ইসরাইলি নাগরিকদের অপহরণ করার চেষ্টা করছে এবং সে কারণে ইসরাইলি নাগরিকরা যেন তুরস্ক ত্যাগ করে'। এর পরপরই তুরস্কের গোয়েন্দা সূত্র আটজন ইরানি নাগরিককে আটকের খবর দেয়। ইসরাইল আরো দাবি করে, ইসরাইলের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও তার স্ত্রীকে ইরানিরা টার্গেট করেছিল কিন্তু তুরস্কের গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতায় ইরানিদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলিদের এ ধরনের অপপ্রচার নতুন কিছু নয় এবং এটা তাদের স্বাভাবিক ও চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তুরস্ক এখন ইসরাইলের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং প্রচারণা চালিয়ে তারা ইরান ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ অবস্থায় তুরস্কের কর্মকর্তাদেরকে খুবই সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। কেননা তুর্কি কর্মকর্তারা এটা ভালো করেই জানেন যে ইসরাইল ও সৌদি নেতাদের তুরস্ক সফর ছিল কৌশলগত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ।
যাইহোক, ইহুদিবাদী ইসরাইল নতুন করে আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যুটি চিরতরে চাপা পড়ে যায়। অর্থাৎ ইসরাইলি আগ্রাসী নীতির সাথে আরব দেশগুলোকেও শরীক করার চেষ্টা করছে ইসরাইল। অন্যদিকে ইরান যাতে এ অঞ্চলের কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে সেজন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে তেলআবিব।
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।