আগস্ট ১৬, ২০২২ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা তূরের সংক্ষিপ্ত তাফসির। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় পরকাল এবং মৃত্যু পরবর্তী জগতে সৎকর্মপরায়ণ ও গোনাহগার ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ১ থেকে ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِیم

وَالطُّورِ ﴿١﴾ وَکِتَابٍ مَسْطُورٍ ﴿٢﴾ فِی رَقٍّ مَنْشُورٍ ﴿٣﴾ وَالْبَیْتِ الْمَعْمُورِ ﴿٤﴾

“শপথ তূর [পাহাড়ের] ।” (৫২:১)

“এবং শপথ কিতাবের যা লিখিত আছে।” (৫২:২)

“উন্মুক্ত পৃষ্ঠায়।” (৫২:৩)

“এবং শপথ সেই আবাদকৃত ঘরের।” (৫২:৪)

পবিত্র কুরআনের আরো অনেক সূরার মতো এই সূরাও কয়েকটি শপথ দিয়ে শুরু হয়েছে। এখানে দুই ধরনের শপথ করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে পবিত্র বিষয় এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রাকৃতিক ঘটনাবলী। যে তিনটি পবিত্র বিষয়ের শপথ করা হয়েছে সেগুলো হলো- তূর পাহাড়; যেখানে হযরত মূসা (আ.) তাওরাত গ্রন্থ গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিষয় হলো- পবিত্র কিতাবসমূহ যা হযরত মূসাসহ অন্যান্য রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে।  আর তৃতীয়টি হচ্ছে- আল্লাহর একত্ববাদের মূলকেন্দ্র ক্বাবা শরিফ যেটি হযরত ইব্রাহিম (আ.) পুনর্নির্মাণ করেছিলেন এবং যুগে যুগে আল্লাহর ঘর জিয়ারতকারী হাজিদের পদচারণায় আবাদ বা মুখরিত হয়েছে। 

এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- এখানে অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার যুগে কিতাবের শপথ করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কিতাব ও শিক্ষার গুরুত্ব ফুঠে উঠেছে।

২- অতীত নবী-রাসূলদের নাম ও নিদর্শন রক্ষা করা এবং তাদেরকে স্মরণ করা সব ধর্মের অনুসারীদের কর্তব্য। এটি বিশেষ কোনো ধর্মের অনুসারীদের একক দায়িত্ব নয়।

৩- আসমানি কিতাবসমূহকে সর্বোৎকৃষ্ট পদার্থের ওপর লিখতে এবং তা ব্যাপকভাবে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে মানুষ সহজেই এই কিতাবসমূহের শিক্ষা অর্জন করতে পারে।

সূরা তূরের ৫ থেকে ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَالسَّقْفِ الْمَرْفُوعِ ﴿٥﴾ وَالْبَحْرِ الْمَسْجُورِ ﴿٦﴾ إِنَّ عَذَابَ رَبِّکَ لَوَاقِعٌ ﴿٧﴾ مَا لَهُ مِنْ دَافِعٍ ﴿٨﴾

“এবং শপথ সমুন্নত ছাদের [বা আকাশের]।” (৫২:৫)

“এবং শপথ প্রজ্জ্বলিত সাগরের!” (৫২:৬)

“নিঃসন্দেহে আপনার রবের শাস্তি অবশ্যই সংঘটিত হবে।”(৫২:৭)

“এবং এর নিবারণকারী কেউ নেই।” (৫২:৮)

আগের আয়াতগুলোর শপথের সঙ্গে এখানেও সৃষ্টির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের শপথ করা হয়েছে। এর একটি  সুউচ্চ ও সুবিশাল আসমান; সর্বাধুনিক টেলিস্কোপসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা আজ পর্যন্ত পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি বরং প্রতিদিনই নতুন নতুন নিহারিকা ও গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এরপর প্রজ্জ্বলিত ও উদ্বেলিত সাগরের শপথ করা হয়েছে।  কোনো কোনো মুফাসসির এটিকে গলিত ও প্রজ্জ্বলিত লাভার সাগর বলেছেন যা ভূপৃষ্ঠের গভীরে অবস্থান করে এবং বিভিন্ন সময়ে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে সবেগে নির্গত হয়ে আশপাশের এলাকাকে প্লাবিত করে। তবে মুফাসসিরদের অনেকে এটাকে ভূপৃষ্ঠেরই সাগর-মহাসাগর বলে অভিহিত করেছেন যেগুলো কিয়ামতের আগ মুহূর্তে মহাপ্রলয়ের দিন উদ্বেলিত ও প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে। এই ঘটনার পরই কিয়ামত সংঘটিত হবে যা গোনাহগার ও জালিমদের জন্য হবে অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ। সেদিন আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার বা ওই শাস্তি প্রতিহত করার কোনো উপায় থাকবে না।

এই চার আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- পবিত্র কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করার মাধ্যমে আমরা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার লক্ষণগুলো এবং এর অবশ্যম্ভাবিতা উপলব্ধি করতে পারি।

২- পার্থিব জীবনের শাস্তিগুলো ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু গোনাহগার ব্যক্তিদের আসল শাস্তি হবে পরকালে যা থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না।

সূরা তূরের ৯ থেকে ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

یَوْمَ تَمُورُ السَّمَاءُ مَوْرًا ﴿٩﴾ وَتَسِیرُ الْجِبَالُ سَیْرًا ﴿١٠﴾ فَوَیْلٌ یَوْمَئِذٍ لِلْمُکَذِّبِینَ ﴿١١﴾ الَّذِینَ هُمْ فِی خَوْضٍ یَلْعَبُونَ ﴿١٢﴾

“যেদিন আসমান আন্দোলিত হবে প্রবলভাবে।” (৫২:৯)

“এবং পর্বতসমূহ [নিজ স্থান থেকে] উৎপাটিত হয়ে সবেগে চলতে থাকবে।” (৫২:১০)

“অতঃএব সেদিন দুর্ভোগ সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য!” (৫২:১১)

“যারা অসার কার্যকলাপে নিমগ্ন এবং [আল্লাহর আয়াতসূমহ সম্পর্কে] বিদ্রূপাত্মক কথাবার্তায় লিপ্ত।” (৫২:১২)

এই আয়াতগুলোতে কিয়ামতের আগ মুহূর্তে আসমান ও জমিনের ভয়াল পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: পৃথিবীসহ সকল গ্রহ-নক্ষত্রের স্বাভাবিক আবর্তনের ব্যবস্থা সেদিন ভেঙে পড়বে। নক্ষত্রসমূহ সেদিন নিজ নিজ কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়বে এবং পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ লেগে আকাশ ধোঁয়া ও ধুলায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি সেটি নিজ অক্ষের উপর এবং সূর্যের কক্ষপথে অনবরত প্রচণ্ড গতিতে ঘুর্ণায়মান থাকা সত্ত্বেও আমরা ভূপৃষ্ঠকে শান্ত দেখতে পাই এবং এর উপর স্বাভাবিক কাজকর্ম করি। কিন্তু কিয়ামতের দিন ভূপৃষ্ঠের এই সুবিশাল পাহাড়-পর্বতগুলো নিজ নিজ স্থান থেকে উৎপাটিত হয়ে সবেগে চলতে থাকবে। সার্বিকভাবে এই আয়াতগুলো একথা বোঝানো হচ্ছে যে, যে পৃথিবী আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি তাতে আমূল পরিবর্তন আসবে এবং সম্পূর্ণ নতুন বিশ্বব্যবস্থা চালু হবে। সেদিন মানুষ পার্থিব জীবনে নিজ কর্মকাণ্ডের পরিণতির মুখোমুখি হবে।

পৃথিবীতে যারা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করেছে সেদিন তারা বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হবে এবং নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু সেদিনের উপলব্ধি কোনো কাজে আসবে না। স্বচক্ষে কিয়ামত দিবস প্রত্যক্ষ করার পর তা মেনে নেওয়া কিংবা পার্থিব জীবনে এই দিবস সম্পর্কে বলা বিদ্রূপাত্মক কথাবার্তা সম্পর্কে সেদিনের অনুশোচনায় কোনো ফল হবে না। সেদিন নতুন করে তওবা করার বা অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে না বরং সেদিন হবে শুধুমাত্র কৃতকর্মের ফল পাওয়ার দিন।

এই চার আয়াতের দুটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- বিশ্বজগতের বর্তমান ব্যবস্থা ওলট-পালট হয়ে নতুন একটি ব্যবস্থা তৈরি হবে এবং সেটিই হবে কিয়ামত। সেই জগতের নিয়ম-কানুন হবে সম্পূর্ণ নতুন যা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করবেন।

২- কিয়ামত অস্বীকারকারীদের কোনো দলিল বা যুক্তি নেই। তারা নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখার কৌশল হিসেবে কিয়ামত সম্পর্কে ভ্রান্ত কথা বলে বেড়ায়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ