আগস্ট ১৬, ২০২২ ১৮:২৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা তূরের সংক্ষিপ্ত তাফসির। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় পরকাল এবং মৃত্যু পরবর্তী জগতে সৎকর্মপরায়ণ ও গোনাহগার ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ৩২ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 أَمْ تَأْمُرُهُمْ أَحْلامُهُمْ بِهَذَا أَمْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ ﴿٣٢﴾ أَمْ یَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَلْ لا یُؤْمِنُونَ ﴿٣٣﴾ فَلْیَأْتُوا بِحَدِیثٍ مِثْلِهِ إِنْ کَانُوا صَادِقِینَ ﴿٣٤﴾

"তাদের বিবেক-বুদ্ধি তাদেরকে এ বিষয়ে (অর্থাৎ রাসূল সম্পর্কে উদ্ভট কথাবার্তা বলতে) প্ররোচিত করে নাকি তারা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়?” (৫২:৩২)

“নাকি তারা বলে, এ কুরআন [আল্লাহর নবী] নিজে থেকে বানিয়ে বলেছে? বরং তারা [নিজেদের সীমালঙ্ঘন ও বিদ্বেষের কারণে] ঈমান আনবে না।” (৫২:৩৩)

“তারা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে তাহলে এই সদৃশ কোন বক্তব্য উপস্থাপন করুক।” (৫২:৩৪)

রাসূলে আকরাম (সা.) সম্পর্কে কাফেররা যেসব উদ্ভট ও অবমাননাকর কথা বলত গত আসরে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: যে নবী দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে তাদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁকে গণক, কবি কিংবা পাগল বলে তারা যে বক্তব্য দেয় সেটি কি তাদের বিবেক থেকে উৎসারিত? না, তাদের বিবেক এমন কথা বলতে পারে না বরং তারা সত্যের মোকাবিলায় আত্মম্ভরিতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় এতটা অন্ধ হয়ে গেছে যে, এমন ঔদ্ধত্বপূর্ণ কথা বলতেও তাদের বিবেকে বাধেনি। তারা ঈমান আনতে চায় না বলে নবীকে নিজের বক্তব্য আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়ার দায়েও অভিযুক্ত করার ধৃষ্টতা দেখায়। যদি তোমাদের বক্তব্য সত্যি হয়ে থাকে তাহলে নবী যে বাণী পড়ে শোনান পারলে তোমরা তার অনুরূপ কোনো বক্তব্য উপস্থিত করো। তোমরা প্রমাণ করো, নবীর বক্তব্য মিথ্যা এবং যে কারো পক্ষে এমন বক্তব্য দেওয়া সম্ভব।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- আল্লাহর বাণী অস্বীকার ও কুফরির মূলে রয়েছে মানুষের স্বেচ্ছাচারী আচরণ; তার বিবেক কখনও কুফরি করার অনুমতি দেয় না।

২- মানুষকে নবী-রাসূলদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যুগে যুগে কাফিররা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের প্রতি নানারকম অপবাদ আরোপ করেছে।

৩- ইসলামের নবী (সা.)-এর প্রকাশ্য মুজিযা ছিল পবিত্র কুরআন। কাফিররা শত চেষ্টা করেও এই মহাগ্রন্থের একটি আয়াতের সমতুল্য কোনো আয়াত রচনা করতে পারেনি।

সূরা তূরের ৩৫ থেকে ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَیْرِ شَیْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ ﴿٣٥﴾ أَمْ خَلَقُوا السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ بَل لا یُوقِنُونَ ﴿٣٦﴾

“তারা কি অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়েছে? নাকি নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা?”(৫২:৩৫)

“নাকি তারা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং [সত্য এটাই যে তারা] দৃঢ় বিশ্বাস করতে চায় না।”  (৫২:৩৬)

এই দুই আয়াতে আল্লাহকে চেনার একটি অকাট্য যুক্তি পেশ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, কোনো সৃষ্টিকেই কারণ ছাড়া সৃষ্টি করা হয় না। আর কোনো সৃষ্টি নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারে না বরং কেউ না কেউ তাকে সৃষ্টি করে। বিশ্বের কোনো মানুষ একথা দাবি করতে পারবে না যে, সে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে বা তাকে বিনা কারণে ছাড়া সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই মানুষসহ গোটা বিশ্বজগতের যে একজন স্রষ্টা রয়েছেন সেকথা সুস্থ বিবেকসম্পন্ন যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য। মক্কার কাফির ও মুশরিকরা পর্যন্ত এই সত্য স্বীকার করত।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- পবিত্র কুরআন বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে মানুষকে চিন্তা-গবেষণা করতে উৎসাহিত করে যাতে তার বিবেক জাগ্রত হয় এবং সে সত্য গ্রহণ করে।

২- মানুষ যদি সত্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয় তাহলে তার বিবেক তাকে এ কাজে সহায়তা করে।

৩- মানুষ যেমন নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারেনি তেমনি সে আসমান-জমিনেরও স্রষ্টা নয়।

সূরা তূরের ৩৭ থেকে ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

أَمْ عِنْدَهُمْ خَزَائِنُ رَبِّکَ أَمْ هُمُ الْمُسَیْطِرُونَ ﴿٣٧﴾ أَمْ لَهُمْ سُلَّمٌ یَسْتَمِعُونَ فِیهِ فَلْیَأْتِ مُسْتَمِعُهُمْ بِسُلْطَانٍ مُبِینٍ ﴿٣٨﴾ أَمْ لَهُ الْبَنَاتُ وَلَکُمُ الْبَنُونَ ﴿٣٩﴾ أَمْ تَسْأَلُهُمْ أَجْرًا فَهُمْ مِنْ مَغْرَمٍ مُثْقَلُونَ ﴿٤٠﴾

“আপনার রবের গুপ্তভান্ডার কি তাদের কাছে আছে, নাকি তারা [গোটা বিশ্বজগত] নিয়ন্ত্রণকারী?  (৫২:৩৭)

“নাকি তাদের আছে কোনো সিঁড়ি, যাতে চড়ে তারা (ঊর্ধ্বলোকের রহস্য) শুনতে পায়? [যদি শুনতে পায় তাহলে] তাদের সে শ্রোতা স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করুক।”  (৫২:৩৮)

“তবে কি [তোমরা ধরে নিয়েছ] কন্যা সন্তান তাঁর এবং পুত্ৰ সন্তান তোমাদের [জন্য নির্ধারিত]?”  (৫২:৩৯)

“তবে কি আপনি ওদের কাছে পারিশ্রমিক চাচ্ছেন যে, তারা এটাকে একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে?”  (৫২:৪০)

আগের আয়াতগুলোর মতো এই চার আয়াতেও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে।  বলা হচ্ছে: যদি তোমরা একথা মেনে নিয়ে থাকো যে, তোমরা বিশ্বজগতের স্রষ্টা নও তাহলে কি তোমরা এটা দাবি করছো যে, বিশ্বজগত পরিচালনা এবং সবার জীবিকা নির্বাহ করার দায়িত্ব তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে? তোমরা কীভাবে আশা করো যে, বিশ্বজগতের স্রষ্টা নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে নবী না বানিয়ে তোমাদের চাহিদা অনুযায়ী নবী নিয়োগ দেবেন? নবীর বক্তব্য যখন তোমাদের পছন্দ হয় না তখন আল্লাহর ওহী শোনার জন্য তোমাদের কাছে কি আসমানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কোনো সিঁড়ি আছে? যদি থাকে তাহলে তোমরা আল্লাহর ওহী শুনতে পাওয়ার প্রমাণ উপস্থাপন করো।  

এসব আয়াতে আরো বলা হচ্ছে, কাফিররা যে দাবি করে, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা- এর পক্ষে তাদের কাছে কি কোনো যুক্তি আছে? আর তারা নিজেদেরকে কেন পুত্র সন্তানের পিতা এবং আল্লাহকে কন্যা সন্তানের পিতা নির্ধারণ করছে? তাদের কাছে আল্লাহর রাসূল কি কোনো পারিশ্রমিক দাবি করছে যা পরিশোধ করতে না পেরে তারা তাঁর রিসালাত গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না?

এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর একত্ববাদের বিরোধীদের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর ছিল না। তারা শুধু সত্য গ্রহণ না করার পক্ষে নানারকম ভ্রান্ত যুক্তি তুলে ধরার প্রয়াস পেত।

এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- যেকোনো বিষয়ে আমাদের মতের বিরোধীরা যদি কোনো যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরে তাহলে আমাদের উচিত গোঁড়ামি না করে তা মেনে নেওয়া।

২- যারা আল্লাহর প্রতি কন্যা সন্তান ধারণ করার মতো জঘন্য অপবাদ দিতে কুণ্ঠিত হয় না তারা রাসূলের প্রতিও অনায়াসে যেকোনো অপবাদ দিতে পারে।

৩- দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে আমাদেরকেও নবী-রাসূলদের মতো মানুষের কাছে অর্থ-সম্পদ চাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, তাতে দাওয়াতের প্রভাব নষ্ট হয়ে যাবে এবং মানুষ আর্থিক চাপের সম্মুখীন হবে। অবশ্য মানুষ যদি স্বতস্ফূর্তভাবে কোনো সাহায্য করে কিংবা উপহার প্রদান করে তাহলে তা গ্রহণ করতে আপত্তি নেই।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ