আগস্ট ১৬, ২০২২ ১৮:৫৮ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা তূরের সংক্ষিপ্ত তাফসিরের শেষ পর্ব। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় পরকাল এবং মৃত্যু পরবর্তী জগতে সৎকর্মপরায়ণ ও গোনাহগার ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ৪১ থেকে ৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

أَمْ عِنْدَهُمُ الْغَیْبُ فَهُمْ یَکْتُبُونَ ﴿٤١﴾ أَمْ یُرِیدُونَ کَیْدًا فَالَّذِینَ کَفَرُوا هُمُ الْمَکِیدُونَ ﴿٤٢﴾ أَمْ لَهُمْ إِلَهٌ غَیْرُ اللَّهِ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا یُشْرِکُونَ ﴿٤٣﴾

"নাকি তাদের অদৃশ্যের জ্ঞান আছে যে, তারা [যা কিছু লিখতে চায় তা লৌহে মাহফুজ থেকে] লিখে রাখে?”(৫২:৪১)

“নাকি তারা [সত্যকে ধ্বংস করার জন্য] কোন ষড়যন্ত্র করতে চায়? কিন্তু পরিণামে কাফিররাই হয়েছে ষড়যন্ত্রে শিকার।” (৫২:৪২)

“নাকি আল্লাহ ছাড়া ওদের অন্য কোন ইলাহ আছে? তারা যে শিরক স্থির করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্ৰ!” (৫২:৪৩)

গত আসরে আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের প্রতি এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন যে, তারা কিসের ভিত্তিতে মহানবী (সা.)’র প্রতি অপবাদ আরোপ করে? এরপর আজকের এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: কাফিররা কি এই দাবি করতে চায় যে, তারা অদৃশ্যের বিষয়াবলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এবং সরাসরি আল্লাহর ওহীপ্রাপ্ত হয়? কারণ, একমাত্র সরাসরি ওহীপ্রাপ্ত হলেই আল্লাহর রাসূল যেসব বাণী তাদের শোনান তা থেকে তারা অমুখাপেক্ষী হতে পারে।

নাকি তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে হত্যা করার জন্য কোনো ষড়যন্ত্র করেছে? যদি সেরকম কোনো দুরভিসন্ধি তাদের থেকে থাকে তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত তারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনে রয়েছে এবং তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে তারাই পতিত হবে।  তারা আল্লাহর সঙ্গে যেসব মিথ্যা খোদাকে শরিক বানায় তারা তাদেরকে আল্লাহর ক্ষমতার সামনে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারবে না।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদের কাছে দাওয়াতের বাণী পৌঁছৈ দেওয়ার একটি উত্তম পন্থা হলো তাদের সামনে বিভিন্ন ধরনের যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা।

২- নবী-রাসূল ছাড়া আর যে কেউ অদৃশ্যের খবর জানার দাবি করবে তা হবে ভ্রান্ত দাবি।

৩- ঈমানের বলে বলীয়ান মানুষদের পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এ ধরনের মানুষদের বিরুদ্ধে কাফিরদের ষড়যন্ত্র আল্লাহই নস্যাত করে দেন।

সূরা তূরের ৪৪ থেকে ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَإِنْ یَرَوْا کِسْفًا مِنَ السَّمَاءِ سَاقِطًا یَقُولُوا سَحَابٌ مَرْکُومٌ ﴿٤٤﴾ فَذَرْهُمْ حَتَّى یُلاقُوا یَوْمَهُمُ الَّذِی فِیهِ یُصْعَقُونَ ﴿٤٥﴾ یَوْمَ لا یُغْنِی عَنْهُمْ کَیْدُهُمْ شَیْئًا وَلا هُمْ یُنْصَرُونَ ﴿٤٦﴾

“তারা আকাশের কোন অংশ ভেঙে পড়তে দেখলে [তারপরও ঈমান আনবে না বরং] বলবে, এটা তো এক পুঞ্জীভূত মেঘ।” (৫২:৪৪)

“সুতরাং তাদেরকে [তাদের নিয়ন্ত্রণে] ছেড়ে দিন যতক্ষণ না তারা সাক্ষাৎ করে সেদিনের, যেদিন তারা হবে বজ্রাহত।” (৫২:৪৫)

“সেদিন তাদের ষড়যন্ত্র তাদের কোন কাজে আসবে না, আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।” (৫২:৪৬)

এই আয়াতগুলোতে কাফির ও অবিশ্বাসীদের অবাধ্যতা ও গোঁয়ার্তুমির চরম সীমার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: তারা যদি নিজেদের চোখে আল্লাহর আজাব হিসেবে আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হতে দেখে তবুও তারা তা অস্বীকার করে। তারা বলে, এগুলো পুঞ্জিভুত মেঘ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা শুধু আধ্যাত্মিক বিষয়াবলীকেই অস্বীকার করে না বরং নিজেদের চোখে দেখা ও অনুধাবনযোগ্য বাস্তবতাকেও মেনে নিতে রাজি নয়।

এ কারণে পরের আয়াতে রাসূলকে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: এসব মানুষকে আর দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা ঘুমিয়ে নেই যে আপনি তাদের জাগ্রত করবেন বরং তারা জেগে জেগে ঘুমের ভান করছে; কাজেই তাদেরকে জাগ্রত করা আপনার কাজ নয়। একমাত্র মৃত্যুই পারবে তাদেরকে এই অবাধ্যতার ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে কিন্তু সেদিনের উপলব্ধি তাদের কোনো কাজে আসবে না। এছাড়া, দ্বীনকে ধ্বংস করার জন্য তারা যত ষড়যন্ত্রই করুক তা ফলপ্রসু হবে না এবং তারা কোনো উদ্ধারকারীও পাবে না।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- জেদ ও গোঁয়ার্তুমি মানুষকে অন্ধ করে তোলে এবং জেদি মানুষ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে না। জেদ তাকে বাস্তবতা সম্পর্কে ভুল বিশ্লেষণে বাধ্য করে এবং সে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়।

২- রাসূলের দায়িত্ব ছিল তাদের সামনে হকের দাওয়াত তুলে ধরা যারা সত্য গ্রহণে আগ্রহী; অবাধ্য ও গোঁয়ার লোকদের সামনে নয়।

৩- কাফিররা কখনও তাদের মৃত্যু বা ধ্বংসের কথা চিন্তা করে না।  তারা ভাবে মৃত্যু তাদের স্পর্শ করবে না এবং তারা যেকোনো মূল্যে তাদের অশুভ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা তাদেরকে পাকড়াও করবেন এবং তাদের পরিকল্পনাগুলো আলোর মুখ দেখবে না।

সূরা তূরের ৪৭ থেকে ৪৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَإِنَّ لِلَّذِینَ ظَلَمُوا عَذَابًا دُونَ ذَلِکَ وَلَکِنَّ أَکْثَرَهُمْ لا یَعْلَمُونَ ﴿٤٧﴾ وَاصْبِرْ لِحُکْمِ رَبِّکَ فَإِنَّکَ بِأَعْیُنِنَا وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّکَ حِینَ تَقُومُ ﴿٤٨﴾ وَمِنَ اللَّیْلِ فَسَبِّحْهُ وَإِدْبَارَ النُّجُومِ ﴿٤٩﴾  

“আর নিশ্চয় যারা যুলুম করেছে তাদের জন্য রয়েছে এছাড়া [আরো] শাস্তি। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।”  (৫২:৪৭)

“আর আপনি আপনার রবের নির্দেশ [পালন করার জন্য] ধৈর্য ধারণ করুন; আপনি আমার চোখের সামনে [এবং আমার সাহায্যের অধীনেই] রয়েছেন।  আর যখন আপনি শয্যা ত্যাগ করেন তখন আপনার রবের প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন। ” (৫২:৪৮)

“আর রাতের একাংশে ও [রাতের শেষভাগে যখন] তারকারাজি অস্তমিত হয়ে যায় তখন আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করুন।” (৫২:৪৯)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই তিন আয়াতের প্রথম আয়াতে অবাধ্য কাফিরদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ ও ঐশী আজাব নাজিল হওয়া সম্পর্কে বলা হচ্ছে: শুধু যে পরকালে তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে তা নয় বরং পার্থিব জীবনে এবং মৃত্যুর পর কিয়ামত দিবসের আগ পর্যন্ত বারযাখি জীবনেও তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু তারা আল্লাহর ওহী সম্পর্কে অবগত নয় বলে তাদের বিষয়টি জানা নেই; তাই তারা ওই ভয়াবহ আজাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিজেদের সংশোধন করার কোনো উদ্যোগ নেয় না।

আগের আয়াতগুলোতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি কাফিরদের নানা ষড়যন্ত্র ও অপবাদের কথা বর্ণনা করার পর সূরা তূরের শেষ দুই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলছেন: আপনার প্রতি যে গুরুদায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তা পালনের ক্ষেত্রে আপনি অটল ও অবিচল থাকুন। আপনার প্রতি আমার সাহায্যের হাত প্রতি মুহূর্তে খোলা রয়েছে এবং আপনাকে আমি ক্ষণিকের জন্যও ভুলে যাইনি। আর আপনি নিজের অন্তরকে শক্তিশালী করা এবং আল্লাহর সঙ্গে আপনার পক্ষ থেকে সম্পর্ক অবিরাম রাখার জন্য প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায় আমার প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনা করুন। এতে করে সর্বশক্তিমানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অটুট থাকবে এবং আপনি কারো মুখাপেক্ষী হবেন না।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- জালিমরা পার্থিব ও পরকালীন জীবনে নিজেদের কর্মফল সম্পর্কে অবহিত নয়। যদি থাকত তাহলে নিজের পাশাপাশি অপরের ওপর জুলুম করতে পারত না।

২- আল্লাহর দ্বীন রক্ষার জন্য উদ্ধত কাফিরদের প্রতিহত করতে হবে। আর এ পথে সকল বাধাবিপত্তি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

৩- যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও জিহাদ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখতে পান এবং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ যাকে সাহায্য করেন তার ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই।

৪- আল্লাহর জিকির করা, তাঁর কাছে দোয়া, মুনাজাত ও কান্নাকাটি করার মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মা শক্তিশালী হয় এবং তার মধ্যে মানসিক প্রশান্তি আসে। অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় এই প্রশান্তি অর্জন করা সম্ভব নয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ