আগস্ট ১৭, ২০২২ ১৮:৪২ Asia/Dhaka

ইসলাম ধর্ম জ্ঞানার্জন ও বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করায় তা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে মুসলিম  মনীষীরা অনেক বড় বড় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। গণিতের ওপর মুসলমানদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ইউরোপে গেছে এবং বলা যায় সেখান থেকে তা সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়েছে।

মানব সমাজে গণিতসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইরানি মনীষীদের অবদান ও গবেষণাকর্ম কখনোই ভুলে যাবার মতো নয়। এ ক্ষেত্রে ইরানিদের সাফল্যের বড় কারণ হচ্ছে সাবেক পারস্য সাম্রাজ্যের শাসানিয় শাসকরা এ বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিতেন এবং তারা ব্যাপক সফলও হয়েছিল। সাফল্যের সেই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইরানের মনীষীরা আরো নতুন নতুন সাফল্যের পরিচয় দিতে থাকেন। গণিতশাস্ত্রে ইরানিদের বইপুস্তক গ্রিক, সুরিয়ানি ও হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এরফলে ওই জাতিগুলোর মধ্যে প্রচলিত গণিতশাস্ত্র আরো সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণতা লাভ করে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে অনেক ইরানি গণিতবিদ জ্যোতির্বিদ্যা এবং গাণিতিক সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে পেয়েছেন এবং তাদের কারণে জ্ঞানের এই দুই শাখায় ব্যাপক উন্নতি হয়। তারা জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে এমন কিছু নতুন তত্ব তুলে ধরতে সক্ষম হন যা ছিল নজিরবিহীন। ইরানের খ্যাতনামা এসব মনীষীদের মধ্যে আবু মাশার আল বালখি, মোহাম্মদ বিন মুসা খাওয়ারিজমি, আবু রেইহান বিরুনি, ওমর খৈয়াম নিশাবুরি, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি, গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানি প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করা যায়।

মধ্যযুগে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে আল খাওয়ারিজমি ছিলেন অন্যতম ও সেরা একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি আধুনিক বীজগণিতের জনক। যদিও তিনি বীজগণিতের জনক কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই তার নামটি অজানা। এটাও অনেকে জানেনা যে, বীজগণিতের জনক হচ্ছে একজন মুসলিম গণিতবিদ। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এই বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদের জীবনী ও অবদান সম্পর্কে।

আল খাওয়ারিজমি একাধারে একজন গণিতবিদ, ভৌগোলিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। পাটিগণিতে তিনিই প্রথম দশমিক ও শূন্যে'র ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেন।  এছাড়াও তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, সূর্যঘড়ি, বর্ষপঞ্জি, ম্যাগনিফাইং গ্লাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেছেন। ইসলামের স্বর্ণযুগের এই মনীষীর রচিত গ্রন্থগুলো এখনো আমাদের নতুন নতুন জ্ঞানের সন্ধান দেয়।

খাওয়ারিজমির পুরো নাম হলো আবু মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। অনুমান করা হয় যে, ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আল খাওয়ারিজমি বাগদাদে খলিফা আল মানসুরের বায়তুল হিকমা সংলগ্ন গ্রন্থাগারে চাকরি করতেন। সেখানেই তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যামিতিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তবে মূলত: বীজগণিতের জন্যই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন।

ব্যাপক অধ্যয়ন করে তিনি বিজ্ঞানের যাবতীয় বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন। আল খাওয়ারিজমির বিশেষ অবদানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন জগৎবিখ্যাত গণিতবিদ। তার সময়ের গণিতের জ্ঞানকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলেন। একজন গণিতবিদ  হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিদও। ভূগোল বিষয়ে তার গবেষণার ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। তিনি ছিলেন অ্যালজেবরার জনক। তিনি প্রথম আল জাবর আল মোকাবেলা বইয়ে এ শব্দটি উল্লেখ করেন।

আধুনিক প্রযুক্তি অনেকটা দাঁড়িয়ে আছে অ্যালগরিদমের উপর। অ্যালগরিদম হচ্ছে সংখ্যার কতগুলি সুনির্দিষ্ট ও ধারাবাহিক ধাপের সমষ্টি। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, রোবট ইত্যাদি এই ধাপগুলোর মাধ্যমে কাজ করে। আমাদের অতি প্রয়োজনীয় ইন্টারনেটও চলে অ্যালগরিদমের কারবারে। এমনকি ফেসবুক, টুইটার ইউটিউব ইত্যাদিও চলে অনেক জটিল অ্যালগরিদমে। কম্পিউটার যে নির্দেশনা অনুসারে কাজ করে সেই নির্দেশনা তৈরি করার জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখা হয়। এই কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখার সময় বিভিন্ন রকমের স্টেপ থাকে, সেই স্টেপ অনুসারে কম্পিউটার কাজ করে।

আপনি যখন কম্পিউটারকে কোনো কাজ দিবেন তখন এটাও আপনাকে ভাবতে হবে কিভাবে কম্পিউটার আপনার দেওয়া কাজগুলো করতে পারবে। আর এই কারণে আমরা কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করি। অ্যালগরিদম হলো এমন কিছু বিশেষ নির্দেশনাবলীর স্টেপ যার মাধ্যমে বিশেষ কোনো সমস্যার সমাধান করা হয়। আরো সহজভাবে বলা যায়, অ্যালগরিদম হলো কোনো সমস্যার সমাধান বের করার একটি স্টেপ বাই স্টেপ প্রক্রিয়া।

মধ্যযুগের মনীষী আল খাওয়ারিজমিই প্রথম অ্যালগরিদম নিয়ে নানান রকমের গবেষণা করেন। বর্তমান অ্যালগরিদমের যে রূপ তার অনেকটাই পূর্ণতা পেয়েছে প্রায় ১২০০ বছরেরও আগে করা আল খাওয়ারিজমির গবেষণার ফলে। খাওয়ারিজমির রচিত গ্রন্থ 'আল জাবর আল মুকাবলা' ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো। তিনি প্রথম রৈখিক (Linear) এবং দ্বিঘাত (Quadratic) সমীকরণের পদ্ধতিগত সমাধান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বীজগণিতকে একটি স্বাধীন শাখা হিসেবে প্রকাশ ধরেন। তাই খাওয়ারিজমিকে বীজগণিতের জনক বলা হয়।

খাওয়ারিজমি অনেক বই লিখেছেন যেগুলোর অধিকাংশ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। 'আল জাবর আল মোকাবেলা' বইটি তার সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। এই বইটি পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় দ্বাদশ শতকে। অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে এই নতুন বিজ্ঞান পশ্চিমা জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়। এর আগে ইউরোপের কাছে বীজগণিত ছিল একটি অচেনা বিষয়। ইউরোপীয়রা এ বিষয়ে ছিল পুরোপুরি অজ্ঞ। দশম শতাব্দীর ইউসুফ রচিত 'মাফাহাতুল উলন' গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

'কিতাবুল সুরত আল আরত' একটি ভূগোল বিষয়ক বই। এটি পৃথিবীর আকার-আকৃতি বিষয়ক একটি বই। তার এই গ্রন্থটি মূলত ভূগোল সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে রচিত। এটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় এবং অনুবাদকর্মের সাথে মানচিত্রগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/মো.আবুসাঈদ/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।