আগস্ট ১৮, ২০২২ ১৮:২৬ Asia/Dhaka

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে তার সমস্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে একটি বাক্য বলার জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি বলেছিলেন, নো দাইসেল্ফ বা নিজেকে জানো।

গত আসরে আমরা নিজেকে চেনা বা জানার বিভিন্ন স্তর বা ধাপ নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। আজ আমরা নিজেকে চেনা বা জানার পথে বিদ্যমান বাধা সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব।

নিজেকে চিনতে বা জানতে না পারলে আমাদের অনেক সমস্যাই সমাধানের অযোগ্য থেকে যাবে। এ কারণে সুন্দর জীবন অনুষ্ঠানে বারবারই এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি আমরা। নিজেকে চেনা বা জানার জন্য কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হবে, আপনার অবচেতন মনের জগতের খোঁজ-খবর নিতে হবে। আপনার নিজের বাবা-মায়ের বিষয়ে আপনার অনুভূতিটা কেমন তা বোঝার চেষ্টা করুন। একটু স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে বলুন নিজের শৈশব সম্পর্কে আপনার উপলব্ধিটা কেমন। যেসব কারণে আপনি রেগে যান সেসবের একটা তালিকা তৈরি করে ফেলুন। আরও একটা তালিকা করুন ঐসব বিষয়ের, যেগুলো আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। ভেবে দেখুন, কোন মুহূর্তগুলোতে আপনি অন্যের সঙ্গে খুবই স্বাভাবিক এবং কোন সময়টায় আপনি অন্যের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলেন।

আচ্ছা, মানুষ হিসেবে আপনিও নানা সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগেন। ভেবে দেখুনতো এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও চাপ মোকাবেলায় আপনি কি সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করেন, অর্থাৎ এটা বের করার চেষ্টা করুন যে, আপনি এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করেন। কেউ আপনার সমালোচনা করলে আপনি কীভাবে সেটার জবাব দেন? কোন কাজটি করতে আপনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন? অন্যের কোন বৈশিষ্ট্যগুলো আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে? কোন বিষয়গুলো আপনাকে শিহরিত ও রোমাঞ্চিত করে? কখনো কি ভেবে দেখেছেন আপনার সময়কে কীভাবে ব্যবহার করলে তা বেশি কাজে লাগবে? যদি তা না করে থাকেন তাহলে এ বিষয়ে ভাবুন এবং এরও একটি তালিকা তৈরি করুন। এগুলো এমন কিছু প্রশ্ন যেসবের উত্তর আমাদের সবারই জানা উচিত। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে আমাদের অনেকেরই দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে, অনেকের দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তা করতে হতে পারে।

সব মিলিয়ে নিজেকে চেনা বা জানার কাজটা কঠিন। এর কারণ হলো আমরা প্রতিদিন যেসব কাজ করি সেগুলোর অনেকটাই অভ্যাসবশত করি। প্রতিটি কাজ আমরা জেনে-বুঝে চিন্তা-ভাবনা করে সম্পাদন করি না। এর কারণ হলো, আমাদের প্রতিটি কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণের বিষয়ে সতর্ক থাকতে গেলে আমাদের মন-মগজকে সদাসচেতন থাকতে হয়। এর বিপরীতে যদি আমরা ভালো মতো চিন্তা-ভাবনা না করে গড্ডালিকা প্রবাহে গাঁ ভাসিয়ে দিতে পারি তাহলে বিষয়টিকে সহজ বলে মনে হয়, মন-মগজের ওপর চাপও কম পড়ে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় এভাবেই কাটিয়ে দেই। আমাদের মধ্যে আরেকটি প্রবণতা হলো, আমরা নির্ঝঞ্ছাট থেকে আনন্দ উপভোগ করতে চাই। কোনো কিছুকে অপছন্দীয় ও জটিল বলে মনে হলেই আমরা এর ভালো দিকগুলোর দিকে না তাকিয়েই তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমরা সহজে কোনো কিছুর গভীরে যেতে চাই না।

আসলে আমাদের অবচেতন মনে আমাদের প্রত্যাশা, আবেগ ও অনুভূতি মজুদ থাকে যেগুলো আমাদেরকে কোনো কিছুর বিষয়ে গভীর চিন্তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা যদি খুব গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলো হয়তো দেখতে পাবো আমরা যে পেশায় আছি অথবা আমরা যে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছি তা আমাদের জন্য মানানসই নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অবমাননাকর। আমাদের মন-মগজ বিশেষকরে অবচেতন মন এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না। এ কারণেই আমরা নিজেদেরকে বেশিমাত্রায় চিনতে বা জানতে আগ্রহী নই। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এ ক্ষেত্রে আমাদের অবচেতন মনের কারসাজিই সবচেয়ে বেশি। আমাদের অবচেতন মন নিজেকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে দিতে চায় না। কারণ আমরা শৈশব থেকে গভীরভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত নই, নিজেকে জানার চেষ্টা আমাদের মধ্যে ছিল না।

আমাদের অবচেতন মন আমাদের অতীতের সকল অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ, জ্ঞান, আবেগ, বিশ্বাস ও দক্ষতাকে ধারণ করে রেখেছে। আমরা অতীতে যা যা করেছি, ভেবেছি বা অর্জন করেছি, সেই সকল তথ্যই মজুদ থাকে অবচেতন মনের কাছে। তাই যদি দেখা যায় যে, আমরা নতুন এমন কিছু করতে যাচ্ছি যা একেবারেই নতুন  এবং আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার সাথে সাংঘর্ষিক, তখনই বেঁকে বসে আমাদের অবচেতন মন। আমরা ইতিমধ্যেই কোনো নির্দিষ্ট আদর্শে বিশ্বাসী হলে সহজে যেমন নতুন কোনো আদর্শকে গ্রহণ করতে পারি না, অবচেতন মনও তেমনই তার নিজস্ব আদর্শ হতে বিচ্যুত হতে চায় না। ফলে আমরা খুব সচেতনভাবে কোনো নতুন ধরনের কাজ করতে চাইলেও, অবচেতন মন আমাদের টেনে ধরে রাখে।

যেহেতু অবচেতন মনেই অবস্থান করে আমাদের আবেগ, তাই অবচেতন মন চাইলে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আমাদের আচার-ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকেও। একবার যদি আমরা কোনো কাজের বিরুদ্ধে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, তখন আবেগকে চাপা দিয়ে ওই কাজ অব্যহত রাখা হয়ে পড়ে অসম্ভব। যদি আমরা কোনো কাজ করার পেছনে সচেতনভাবে একটি যুক্তি সাজাতে চাই, দেখা যায় ওই সময়ের মধ্যে আমাদের অবচেতন মন সাজিয়ে ফেলেছে বিপক্ষ অবস্থানের দশটি যুক্তি। এভাবে অবচেতন মন আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি, আবেগ, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ, মেজাজ সবকিছুতেই কলকাঠি নাড়তে পারে। ফলে তার কাছে প্রায়ই হার মানতে বাধ্য হয় আমাদের সচেতন মন।

নিজেকে চেনা বা জানার জন্য অবচেতন মনের পিছুটানকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অবচেতন মনের বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগের কারণে আপনি নিজেকে চেনা বা জানার পদক্ষেপ নিতে হয়তো ভয় পাচ্ছেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনার সচেতন মনের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অবচেতন মন বেশি শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হচ্ছে, যার ফলে আপনার ইচ্ছাটি অবদমিতই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু যদি আপনার ইচ্ছাশক্তির মাত্রা অনেক বেশি থাকে এবং আপনার মানসিকতা যদি এমন হয় যে কাজটি আপনাকে করতেই হবে, তাহলে অবচেতন মনের নেতিবাচক আবেগ আপনাকে পিছু টানতে পারবে না।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/আবুসাঈদ/ ১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ