সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২২ ১৭:৫৯ Asia/Dhaka

আজ আমরা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইমামের সামরিক দক্ষতা ও আধ্যাত্মিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি সৈন্যদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল ধরে রাখার ক্ষেত্রে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইরাকের সাদ্দাম বাহিনীর অকস্যাৎ ইরান আগ্রাসনের খবর পাওয়ার পর ইমাম মোটেও উত্তেজিত হননি বা শঙ্কিত বোধ করেননি। তিনি নিজে যেমন এ খবর শোনার পর অটল ও অবিচল থেকেছেন তেমনি দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের উদ্বেগ প্রশমনের চেষ্টা করেছেন। ইমাম খোমেনীর দপ্তরের অন্যতম কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী আনসারি তার আত্মজীবনীতে এ সম্পর্কে লিখেছেন, “যেদিন ইরাকি জঙ্গিবিমানগুলো ইরানের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে বোমাবর্ষণ করে সেদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে ইমামের কাছে ছুটে আসেন। ইমাম তাদেরকে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দেন।”

আলী আনসারি আরো বলেন, “ইমামের দপ্তরে প্রবেশের সময় কর্মকর্তাদের মুখে ছিল শঙ্কা ও উদ্বেগ। কিন্তু দপ্তর থেকে বের হওয়ার সময় তাদের সে উদ্বেগ প্রবল আশা ও দৃঢ় মনোবলে পরিণত হয়। তাদের একজন বলেন, ইরাককে আমরা ধ্বংস করে ফেলব। আরেকজন বলেন, আমরা এমন পাল্টা আঘাত হানব যে, আমাদের বাহিনী ইরাকের রাজধানী বাগদাদ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। ”

এছাড়া, ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালানোর প্রথম প্রহরে জনগণের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য ইমাম জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, “সাদ্দাম বাহিনীর এই আগ্রাসনে ভীত হওয়ার কিছু নেই। আপনারা মনে করবেন, একটি চোর এসে আপনাদের বাড়িতে একটি ঢিল মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছে।” ইমামের এই বক্তব্যে যুদ্ধ পরিচালনা ও সশস্ত্র বাহিনীকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই মহান নেতার অবিচল মনোভাব ও প্রশান্ত চিত্তের পরিচয় পাওয়া যায়।

হযরত ইমাম খোমেনীর চিত্তাকর্ষক ও মনকাড়া ভাষণ ইরানি যোদ্ধাদের অন্তরে গভীর রেখাপাত করত। বিভিন্ন অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা বিজয়ী হওয়ার পর তিনি যে বাণী প্রদান করতেন তার ভাষায় যোদ্ধাদের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত এবং তারা নতুন করে যুদ্ধ করার মনোবল ফিরে পেত।  যোদ্ধাদের উদ্দেশে ইমামের এরকম কয়েকটি বাণী হচ্ছে: “আপনাদের অভিননন্দন! আপনারা আপনাদের মাতৃভূমিকে ফেরেশতাদের ডানায় চড়িয়েছেন এবং সারাবিশ্বের সামনে জন্মভূমির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ” “আমরা ইরাকের বাথ পার্টি ও সাদ্দামের গালে এমন থাপ্পড় মারব যে, তারা আর কোনোদিন উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে না।” “এ যুদ্ধে আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং এ ব্যাপারে মনে বিন্দুমাত্র সংশয় পোষণ করবেন না।”

ইমাম খোমেনীর এ ধরনের বক্তব্য কঠিন কঠিন লড়াই ও অভিযানের পর ক্লান্ত-শ্রান্ত ইরানি যোদ্ধাদের অন্তরকে প্রশান্তি দিত। ইমামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি ইরানি কমান্ডারদের আলাদাভাবে ধন্যবাদ জানাতে ভুলতেন না। কখনও যদি যেকোনো কারণে কোনো অভিযানে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল আসত এবং ইরানি যোদ্ধারা পরাজিত হতো তখন ইমাম ওই বাহিনীর কমান্ডারদের ভর্ৎসনা করতেন না। তিনি বরং এমন সব শব্দ প্রয়োগ করে তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিতেন যাতে কমান্ডার ও যোদ্ধারা বিগত পরাজয়ের কষ্ট ভুলে নতুন করে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা পেত।  একবার ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী হাজ ইমরান এলাকায় ইরানের সেনাবাহিনী কারবালা-সাত অভিযান চালিয়ে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করে। ইরানি যোদ্ধারা সেখানকার আড়াই হাজার মিটার উঁচু একটি কৌশলগত টিলা দখল করতে সক্ষম হন। ইমাম খোমেনী তখন টেলিফোন করে ইরানি কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বলেন ও তাদেরকে অভিনন্দন জানান। ইমামের টেলিফোন পেয়ে ইরানি কমান্ডার ও যোদ্ধারা আবেগে আপ্লুত হন এবং এই খবরে গোটা ফ্রন্ট লাইনে সাড়া পড়ে যায়।

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী সশস্ত্র বাহিনীগুলোতে তাঁর নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের খবর গ্রহণ করতেন। তিনি সঠিক খবর হাতে পাওয়ার বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন এবং সেসব তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করণীয় ঠিক করতেন। যুদ্ধের বড় বড় অভিযানের রোডম্যাপ ইমাম নিজের হাতে ঠিক করে দিতেন। সবার পরামর্শ গ্রহণ করে এবং যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি যে সিদ্ধান্ত নিতেন তা বাস্তবায়নেও তিনি কঠোরতা অবলম্বন করতেন। উদাহরণস্বরূপ, ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় আবাদান শহর যখন শত্রুসেনাবেষ্টিত হয়ে পড়ে এবং দৃশ্যত অবরোধ ভাঙার কোনো উপায় চোখে পড়ে না তখন ইমাম দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আবাদানের অবরোধ যেকোনো উপায়ে ভাঙতে হবে।” ইমামের দীপ্তকণ্ঠের ঘোষণা শুনে ইরানি যোদ্ধারা বীরবিক্রমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সত্যি সত্যি অসম্ভবকে সম্ভব করে সেই অবরোধ ভেঙে ফেলেন।

ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইমাম খোমেনী ছিলেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি ইরাকের আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামরিক কমান্ড প্রদানের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকভাবেও যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেন।  তাঁর যেসব বাণী শুনে ইরানি সৈনিকেরা পাগলপ্রায় হয়ে শত্রুসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত তার একটি হলো: ‘আজ ময়দানে যুদ্ধ ও শাহাদাতের অভিসারের দিন; আজ খোদাপ্রেমে আশেক হওয়ার দিন।’ তার বিচক্ষণ নেতৃত্বে ইরানি যোদ্ধারা শুধু ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় বরং গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে এক ঐতিহাসিক বীরত্বগাঁথা সৃষ্টি করেছিলেন। ইরাক-ইরান আট বছরের যুদ্ধ পর্যালোচনা করতে গেলে ইমাম খোমেনীর প্রেরণাদায়ক ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ