আসমাউল হুসনা (পর্ব-৭৬)
মানুষ দুনিয়ার বুকে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। তবে আল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হতে হলে তাঁর নামগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখতে হবে।
মহান আল্লাহর পবিত্র নামগুলো কেবল এক-একটি শব্দ নয় বরং ব্যাপক অর্থবোধক বিষয়। বিভিন্ন সময়ে এইসব নামের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠে। মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার তালিকাভুক্ত এমনই নাম হল আলমুক্বসিত্বু তথা ন্যায়বিচারকারী বা ইনসাফকারী ও সত্য-সন্ধানী বা ন্যায়কামী। মহান আল্লাহ সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচারক এবং তিনি ন্যায়বিচারক ও ন্যায়বিচারকামীদের ভালোবাসেন । মহান আল্লাহ ন্যায়বিচার করতে তার বান্দা তথা মানুষকে আহ্বান জানান এবং এ বিষয়ে ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে সুরা হুজুরাতের ৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তোমরা ন্যায়বিচার কর। আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন।
মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারক হিসেবে সবাইকে তাদের প্রয়োজন ও লক্ষ্যের আলোকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। এইসব সুযোগ-সুবিধা বা নেয়ামত বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় ধরনেরই হয়ে থাকে।
মহান আল্লাহ নিজের ন্যায়বিচারক হওয়ার কথা সুরা আলে ইমরানের ১৮ নম্বর আয়াতে এভাবে উল্লেখ করেছেন: মহান আল্লাহ নিজের একত্বের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে তাঁর পবিত্র সত্ত্বা তথা এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ বা খোদা নেই যিনি কিস্ত্ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী এবং ফেরেশতাকুল ও জ্ঞানীরাও তাঁর একত্বের সাক্ষ্য দেন, তিনি ছাড়া আর কোনো খোদা নেই যিনি সব কিছুর ওপর কর্তৃত্বশীল ও জ্ঞানী।
এই আয়াত থেকে এটাও বোঝা যায় যে মহান আল্লাহ সব সৃষ্টি ও অস্তিত্বের ওপর কর্তৃত্বশীল ও তিনি ন্যায়বিচারে অবিচল অটল থাকেন এবং তিনি প্রত্যেককে তাদের ধারণ-ক্ষমতা অনুযায়ী দান করে থাকেন। এই আয়াতের শেষাংশে মহান আল্লাহর দুই নাম عزیز আজিজ ও হাকিম حکیم নাম এসেছে। এর অর্থ মহান আল্লাহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা ও হিকমাত বা কৌশল তথা প্রজ্ঞার প্রয়োগ করেন। পবিত্র কুরআনে আমরা দেখতে পাই মহান আল্লাহ খুব স্পষ্টভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন। যেমন, সুরা আরাফের ২৯ নম্বর আয়াত, সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াত এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য।
সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর অবিচল থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতিও হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।
মহান আল্লাহ নিজে ন্যায়বিচারক। তাই তিনি ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন। আর যারা জালিম এবং অন্যদের ওপর নিজের স্বার্থান্ধ মত চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত তথা বলদর্পি তাদেরকে মহান আল্লাহ জাহান্নামের জ্বালানীকাঠ বলে উল্লেখ করেছেন। (সুরা জিন-১৫) এ ধরনের জালিমদেরকে আরবিতে ক্বাসিতিন বলা হয়। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীও তাদের নিন্দা করেছেন। এই শ্রেণীর মানুষই হযরত আলীর ন্যায়বিচারপূর্ণ শাসনের মোকাবেলায় বিদ্রোহ করেছিল ও নানা অজুহাতে হযরত আলীর সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। (নাহজুল বালাঘা-১৯২ নম্বর ভাষণ দ্র.)
মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারক হওয়া সত্ত্বেও জালিমদের জুলুম বা পাপকাজের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের শাস্তি দেন না, বরং তিনি ধৈর্য ধরেন যাতে কেউ কেউ নিজের ভুল বোঝার ও তওবা করার সুযোগ পায়। অন্যদিকে মহান আল্লাহ মানুষকে ভালো ও মন্দ উভয় পথই বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহ সবাইকে জোর করে সত্যের পথে আনতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করে নিজেই ন্যায় ও সত্যের পথ বেছে নেবে। আর এভাবেই মানুষ পূর্ণতা অর্জন করবে।
আবার মহান আল্লাহ কখনও কখনও জালিমদেরকে জুলুম ও বিভ্রান্তির মধ্যেই মগ্ন রাখেন। কারণ এই জালিমরা ভালো পথের দিকে ফিরে আসার সব সেতুগুলো নিজের হাতেই ধ্বংস করেছে। তাই তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুপথ বা পথ-নির্দেশনা পাওয়ার যোগ্যতাই রাখে না। ইয়াজিদের সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পর তার সামনেই ইমাম হুসাইনের বোন হযরত জাইনাব (সা. আ) পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত ইয়াজিদের এই বিশেষ অবস্থার দিকটি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: তুমি আজ উল্লসিত! আর ভাবছ যে দুনিয়াটাকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে ফেলেছ ও আকাশের দিগন্তগুলো আমাদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে ও আমাদেরকে যুদ্ধ-বন্দিদের মত এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছ! এসব কি তোমার ক্ষমতার নিদর্শন? কিংবা আল্লাহর দরবারে তোমার কি কোনো ক্ষমতা ও সম্মান আছে? আল্লাহর দরবারে প্রবেশের কোনো পথ কি আমাদের জন্য খোলা নেই? তুমি ভুল করছ! তোমাকে এই যে সুযোগ ও স্বাধীনতা মহান আল্লাহ দিয়েছেন তা এ জন্যই যে যাতে তোমার পাপের বোঝা ভারি হতেই থাকে এবং তোমার জন্য কঠিন খোদায়ি শাস্তি অপেক্ষা করছে... তাই কিছুটা শান্ত ও সুস্থির হও তুমি কি মহান আল্লাহর এই বাণী ( যা কুরআনের সুরা আলে ইমরানের ১৭৮ নম্বর আয়াত) ভুলে গেছ যে তিনি বলেছেন,
খোদাদ্রোহের পথিক বা কাফেররা যেন মনে না করে যে আমি যে অবকাশ দান করি, তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর। আমি তো তাদেরকে অবকাশ দেই যাতে তাদের পাপ বাড়তেই থাকে। বস্তুত: তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাজনক শাস্তি।
মহান আল্লাহর মুক্বসিত্ব নামের রঙে যারা রঙিন হতে চান তাদের অবশ্যই ন্যায়বিচারকামী হতে হবে জীবনের সব ক্ষেত্রে। তাদেরকে হতে হবে মজলুমের সাহায্যকারী এবং এতে যদি নিজের ক্ষতিও হয়। খোদাসচেতনতা বা খোদাভীতি অর্জনের জন্য তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ন্যায়বিচারকামী হওয়া জরুরি। মানবজাতির জন্য ন্যায়বিচার ও পূর্ণতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ হযরত মুহাম্মাদ (সা) ন্যায়পন্থীদের সম্পর্কে বলেছেন: নিশ্চয়ই ন্যায়বিচারকামীরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে আলোকিত আসন বা মঞ্চসমুহের অধিকারী হবেন। তারা হলেন সেইসব ব্যক্তি যারা রায় বা মতামত প্রদানে ও পরিবার এবং সহধর্মীনিদের মধ্যে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পালন করে থাকেন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/০৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।