সুন্দর জীবন-১৫ (সময় স্বল্পতার কারণ ও প্রতিকার)
ইদানিং আশেপাশের মানুষের কাছে আপনি যে বাক্যটি খুব বেশি শুনে থাকেন তাহলো- 'আমার হাতে সময় নেই। অনেক কাজ পড়ে আছে।' চলুন আজ আমরা মানুষের সময় স্বল্পতার কারণ খোঁজে বের করার চেষ্টা করি। অবাস্তব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণের কারণে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সময় সংকুলানে সমস্যায় পড়ি।
অযৌক্তিক, অবাস্তব ও আকাশচুম্বী লক্ষ্য ও স্বপ্নের কারণে মানুষ কাজের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সব কিছু সামাল দেওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় নিজের সীমিত সামর্থ্য ও সময়ের দিকে খেয়াল করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে হবে, অন্যথায় সময় নিয়ে সমস্যা কাটবে না। সময়ের অভাবের আরেকটি কারণ হলো- গুরুত্ব অনুযায়ী কাজের তালিকা সাজানোতে দক্ষতার অভাব। কোন কাজটি আগে করা উচিত এবং কোনটি পরে করলেও চলবে তা বুঝতে পারেন না অনেকেই।
অন্যের সঙ্গে কাজ ভাগ না করার প্রবণতাও সময় সংকুলান না হওয়ার আরেকটি কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই অন্যদের মাঝে কাজ ভাগ করা জরুরি। এর ফলে নিজের ওপর থেকে চাপ যেমন কমে তেমনি কাজের মানও বাড়ে। অবশ্যই কাজ তাদের সঙ্গেই বণ্টন করতে হবে যারা তা ভালোভাবে সম্পন্ন করার যোগ্যতা রাখে। এমন কারো সঙ্গে কাজ বণ্টন করা যাবে না যিনি ঐ কাজে দক্ষ নয়। কারণ এমনটি হলে ঐ কাজ সংশোধন করতে আরও বেশি সময় ব্যয় হবে যা কাম্য নয়। সময় স্বল্পতার আরেকটি কারণ হলো, কাজ ফেলে রাখা। অর্থাৎ হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকার পরও সময়মতো কাজ সম্পন্ন না করা। আমরা অনেক সময়ই পরে কাজটি করব এটা ভেবে তা ফেলে রাখি। এরপর সময় যখন শেষ হতে থাকে তখন তাড়াহুড়ো করে কাজটি সম্পন্ন করি। এর ফলে কাজের মান তলানিতে গিয়ে ঠেকে। আলসেমি করে বা অবহেলাজনিত কারণে সময়ের কাজ সময়ে না করে কাজ জমিয়ে রাখার অভ্যাসটা আমাদের অনেকের মধ্যেই থাকে। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কাজ জমিয়ে রাখার অভ্যাসটা দ্রুত পরিত্যাগ করা জরুরি। বর্তমান সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে এবং বসে না থেকে এখনই কাজ শুরু করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই আপনি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকবেন যে, আপনার সহকর্মীরা তাদের কাজটি আপনাকে করে দিতে বলবে। আপনি এমন আবেদন গ্রহণ করার আগে ভালোমতো ভেবে দেখুন। আপনি যদি মনে করেন যে, এই কাজটি করলে আপনার অন্য কাজ পিছিয়ে যাবে তাহলে তা ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করুন। সময় সংকুলান করতে পারেন এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল সেই দায়িত্ব গ্রহণ করুন। আমরা অনেক সময় 'না' শব্দটি বলতে পারি না। যে যা বলে তাই মেনে নিতে থাকি। এর ফলে কাজের বোঝা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক সময় তা কাজের গতি আরও কমিয়ে দেয়। সমাজে এমন অনেকেই আছেন যারা পরিপূর্ণতাকামী। অর্থাৎ তারা শতভাগ শুদ্ধতা ছাড়া কোনো কিছুকেই গ্রহণ বা মেনে নেয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গির লোকেরা অনেক সময় কাজের মানকে অতি উচ্চ পর্যায়ে নিতে গিয়ে এত বেশি সময় ব্যয় করে যে, অন্য কাজ করার মতো সময় আর তার থাকে না। আপনি অনেককেই পাবেন যারা বলে থাকে, আমি সবচেয়ে ভালো কাজটি করব অথবা কোনো কাজই করব না। আবার অনেকেই বলে থাকেন, কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না, ফলে কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাই বন্ধ করে দেব। এমন দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়।
কাজের গুরুত্ব বুঝে সময় বণ্টন করতে হবে। একটি কাজ অতি উচ্চ মানে পৌঁছাতে গিয়ে অন্য দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন নয়। কাজের মান বজায় রাখা জরুরি, তা যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না পৌঁছায়। আসলে সময় হচ্ছে যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছার একটা বড় মাধ্যম। সময় হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এটি এমন এক সম্পদ যা হাতছাড়া হলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। এ কারণেই বলা হয়- সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। হারানো স্বাস্থ্য ধন-সম্পদ ফিরে পাওয়া যায়; কিন্তু সময়কে নয় । আপনি যে কাজই করুন না কেন, সেটার জন্য সময়ের প্রয়োজন। আপনি সময়কে যত ভালোভাবে কাজে লাগাবেন আপনি তত বেশি লাভবান হবেন। নিজের ভেতরেও শান্তি অনুভব করবেন। নিজের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না- এমন অনুভূতি কখনো তৈরি হলে বুঝবেন আপনি সমস্যায় পড়ে গেছেন। এর ফলে জন্ম নেবে মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা ও অবসাদ। আপনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর ওপর যত বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন ততো বেশি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করবেন, ততো বেশি ভালো ঘুম হবে আপনার।
সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভুল চিন্তা-বিশ্বাসের কারণে আমরা সঠিক ও যথার্থ উপায়ে কাজ করতে পারি না। আমি নিজেই সব কাজ করব-এমন চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা সঠিক নয়। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া একা সব দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। আমরা সামাজিক জীব, আমরা একে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারব না, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমার জীবন চলার পথের সব কাজ আমিই সম্পন্ন করতে পারব-এটা অবাস্তব ভাবনা। প্রয়োজনে অন্যকে সহযোগী হিসেবে নিতে হবে, কখনো কখনো নিজেকেই অন্যের সহযোগীর স্থানে বসাতে হবে।
আসলে সময় ব্যবস্থাপনা হলো একটি পরিকল্পনা প্রক্রিয়া, যা দিয়ে ঠিক করা হয় কোনো নির্দিষ্ট কাজ করতে কতটুকু সময় ব্যয় করা উচিত। সঠিক সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অল্প সময়ে বেশি কাজ করতে পারেন এবং সার্বিক উন্নতির পথে হাঁটতে পারেন। আমরা অনেকেই সব কাজ একেবারে কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে চাই। এটা ঠিক নয়। কাজের সময়সূচী নির্ধারণ করতে হবে। যখন যেকাজটি করা উচিত তখন সে কাজটি করতে হবে। যথেষ্ট সময় নিয়ে সেই কাজটিতে হাত দিতে হবে। তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই কাজের মান পড়ে যাবে।
অন্য কথায় বলা যায়, দ্রুত সম্পন্ন করতে গিয়ে অথবা বেশি কাজ করতে গিয়ে কাজের মান বিসর্জন দেওয়া চলবে না। অনেকেই ভাবেন সময় ব্যবস্থাপনা বা সময়সূচী নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী কর্মসম্পাদন করার অর্থ হলো নিজের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেওয়া। আসলে এমন চিন্তাও একেবারেই অমূলক। সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আসলে আমরা নিজের জন্য বেশি স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করে থাকি। সময়ের কাজ সময়ে করলে নিজের মধ্যে অসন্তোষ ও উদ্বেগ কমে আসবে যা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে সহযোগিতা করবে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সময় ব্যবস্থা করা যায় আরও বেশি কার্যকরভাবে। একজন ব্যক্তি তার সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে চাইলে তাকে অবশ্যই প্রতিদিনের একটি সময়সূচী অনুসরণ করতে হবে। কাজ করার ক্ষেত্রে লক্ষ্যটা এমন হলে চলবে না যে, আমি যে করেই হোক কাজটি শেষ করব। সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা কাজের গুরুত্ব বোঝে সময়মতো তা সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।