অক্টোবর ২৫, ২০২২ ১৫:৪৭ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-১২৯): ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর চিন্তাদর্শনে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব

ইমাম খোমেনি (রহ.) আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার মাধ্যমে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করতে বিশাল বাহিনী তৈরি করেছিলেন। এর ফলে ইরানের গোটা সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। আর ঈমান গোটা পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ঈমানের কাছে যদি হাতিয়ার না থাকে তাহলে তার পক্ষে কিছু সম্ভব নয়।

যে ব্যক্তির একটি হাতও নেই দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকার পরও তার পক্ষে কোনো কিছু মাটি থেকে তোলা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে কারো কাছে যদি হাতিয়ার থাকে কিন্তু ঈমান না থাকে তাহলে তাকে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা যায় যার দেহ আছে কিন্তু প্রাণ নেই। ঐশী বিশ্ব দর্শনে বলা হয়েছে, মানুষের রুহ বা আত্মা হচ্ছে তার আসল পরিচয় এবং তার দেহ এমন একটি কাঠামো যাতে তার রুহ প্রতিপালিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের শারিরীক শক্তির উৎস হচ্ছে তার রুহ এবং এই রুহ ও আত্মা মিলেই একজন মানুষকে কর্মক্ষম করে তোলে।

এই কর্মক্ষম মানুষ যে মানসিক শক্তি ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে যুদ্ধের ময়দানে তার উপস্থিতি অতি জরুরি। কমান্ডারের নির্দেশ পালন করে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যে মানসিক শক্তি ও অনুপ্রেরণা প্রয়োজন হয় তার যোগান দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যুদ্ধের ময়দানে সম্মিলিতভাবে সব যোদ্ধাকে একত্রে কাজ করতে হয়। সেখানে কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে এক ব্যক্তির জন্য একটি গোটা দলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। কাজেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি যোদ্ধাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হয় এবং প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের বিজয়ে এই আত্মিক শক্তির বিষয়টি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। যদি এই উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা সম্ভব না হতো তাহলে ওই যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে সমরাস্ত্র ও সামরিক সম্ভারের দিক দিয়ে ইরাক ছিল ইরানের তুলনায় বহুগুণে শক্তিশালী।  ইরাকের সাদ্দাম সরকার আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কারণে ইরানের সঙ্গে দেশটির সমরশক্তির তারতম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ইরানের চেয়ে ইরাকের সমরশক্তি কত বেশি ছিল তার একটি চিত্র সামনে থাকলে ওই যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদেরকে কতটা মানসিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে সে সম্পর্কে একটি ধারনা পাওয়া যাবে। তবে একথার অর্থ এই নয় যে, ইরাকি বাহিনী মানসিক শক্তি ছাড়া শুধু সমরাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে এসেছিল এবং ইরানি যোদ্ধারা কোনো অস্ত্রসস্ত্র ছাড়া শুধুমাত্র মানসিক শক্তি ও উদ্দীপনা নিয়ে দেশরক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বরং একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই যুদ্ধে সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে ইরাক ছিল শক্তিশালী আর মানসিক উদ্যোমের দিক দিয়ে ইরান ছিল শক্তিশালী অবস্থানে।

মানুষের মধ্যকার আধ্যাত্মিক শক্তিকে জাগ্রত করে তার কর্ম উদ্দীপনা বাড়িয়ে দেয়ার এই কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছিলেন ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)। অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, সমসাময়িক যুগে ইসলামের ন্যায়কামী ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা জাগ্রত করতে যেসব মনীষী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ইমাম খোমেনী ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন এমন একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যার বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্ম ছিল খাঁটি ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। মানুষের আত্মিক শক্তি জাগ্রত করার দু’টি উপায় বর্ণনা করা হয়। এর একটি অর্জিত হয় ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে অন্যটি মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে। মনোবিজ্ঞানে যে আত্মিক শক্তির কথা বলা হয় তা মানবসৃষ্ট কিছু অর্থহীন ও ভেজাল চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত। অন্যদিকে ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে ঐশী জ্ঞান। ফলে ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তিতে যে আধ্যাত্মিক ও আত্মিক শক্তি অর্জন করা যায় তা অন্য কোনো শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব নয়।

আমরা যদি ইমাম খোমেনীর জীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে চাই তাহলে তাঁর জীবনকে আমরা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলামি জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রবলভাবে আগ্রহী হন। এ পর্যায়ে তিনি মরহুম আয়াতুল্লাহ শাহ-আবাদির মতো বিশিষ্ট আলেমদের সান্নিধ্যে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা অর্জন করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি এসব জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও আরেফে পরিণত হন। তৃতীয় পর্যায়ে তিনি একজন বিশিষ্ট ওস্তাদ হিসেবে ইরানের ধর্মীয় নগরী কোম এবং ইরাকের ধর্মীয় নগরী নাজাফের মাদ্রাসাগুলোতে পাঠদান করেন ও অসংখ্য ছাত্র তৈরি করেন। একই সময়ে তিনি ইসলামি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ বিভিন্ন বই লিখতে আরম্ভ করেন। আর ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনকে ইমামের আধ্যাত্মিক জীবনের চতুর্থ পর্যায় ধরা যায়।

এই পর্যায়ে ইমাম খোমেনী তার জীবনে অর্জিত সব জ্ঞান ইসলামি শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ব্যবহার করেন। তার সুচিন্তিত দিকনির্দেশনায় ইরানের তরুণ সমাজের মধ্যে ধর্মীয় বিধান পালন ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা বেড়ে যায়। ইমাম খোমেনীর চিন্তাদর্শনে ইসলামের যে দিকটি ফুটে উঠত তাকে ইমাম নিজেই ‘ইসলামে নবে মোহাম্মাদি’ বা ‘খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলাম’ নাম দিয়েছেন। এই ইসলামে আধ্যাত্মিকতা ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় যা ইরানের সব শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসলামি বিপ্লবের নেতা, মুজতাহিদ আলেম ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইমাম খোমেনী যেসব বাণী-বক্তব্য দিতেন, যেসব চিঠি ও বই লিখতেন এবং বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে বৈঠকে যেসব কথা বলতেন তার সবকিছুতেই আধ্যাত্মিকতার রেশ পাওয়া যেত।#

 

ট্যাগ