অক্টোবর ২৫, ২০২২ ১৬:৩৭ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস ইতিহাস (১৩০): ঐশী ও বস্তুবাদী বিশ্বাস এবং যেকোনো যুদ্ধে এই বিশ্বাসের প্রভাব

যুদ্ধ শব্দটি শুনলে যেকোনো শ্রোতার মানসপটে হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত ও নৃশংসতার কথা ভেসে ওঠে। কিন্তু আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা কখনোই এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেননি। তারা বরং একনিষ্ঠতা, আত্মত্যাগ, সাহস, বিনয় ও শাহাদাপিয়াসি মনোভাবে এতখানি অগ্রসর ছিলেন যে, কোনো বস্তুবাদী মানদণ্ড দিয়েই তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

ইরানি যোদ্ধাদের এই মহান মানবীয় গুণাবলীতে ইসলামি ইরানের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন। অথচ ইমাম খোমেনী নিজে ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আরেফ এবং তার সঙ্গে ইরানি জনগণের ঘনিষ্ঠ আত্মিক সম্পর্কের কারণে যুদ্ধের প্রতিটি ফ্রন্টে অপূর্ব আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ইরানি শিবিরের এই আধ্যাত্মিক পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ না করলে ওই যুদ্ধে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে তার দোসরদের অপমানজনক পরাজয়ের কারণ উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না।

ইমাম খোমেনী এ সম্পর্কে বলেন, শত্রুরা সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসাব-নিকাষ করেছিল। তবে তারা একটি বিষয়কে বিবেচনায় নেয়নি এবং সেটি হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। তারা উপজাতীয়দের বিষয়টি মাথায় রেখেছিল, আলেমদেরকে প্রতিহত করার পরিকল্পনাও তারা করেছিল কিন্তু ইরানি যোদ্ধাদের আধ্যাত্মিকতা তারা উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা একথা বুঝতে পারেনি যে, ইরানের গোটা জাতি আল্লাহ ও ইসলামের প্রতি অনুরক্ত। ইসলামি ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেন, ইরানের শত্রুদের যেমন আল্লাহর প্রতি ঈমান বা তাঁর ওপর নির্ভরতা ছিল না তেমনি ইরান কীভাবে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল তা বোঝাও ছিল তাদের সাধ্যের বাইরে। আমাদের যদি ঈমান এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা না থাকত তাহলে শত্রুরা যা চেয়েছিল আমাদের পরিণতি তাই হতো; অর্থাৎ ইরানের বিপ্লব ধ্বংস হয়ে যেত এবং ইরানি জনগণ পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হতো।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের শিক্ষার প্রতি ইরানি জনগণের গভীর ঈমান রয়েছে। ঠিক এ কারণে ইমাম খোমেনী একজন আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ইরানি জনগণের অন্তরে স্থান করে নিতে এবং তাদের সমর্থন নিয়ে এদেশ থেকে আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উৎখাত করতে পেরেছিলেন। যে ঈমান ও বিশ্বাস নিয়ে ইরানি জনগণ নিজেদের দেশ থেকে স্বৈরাচারী শাহ সরকারকে সমূলে উৎপাটন করেছে সেই একই বিশ্বাস নিয়ে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করেছে। ঐশী বিশ্বদর্শন ও বস্তুবাদী বিশ্বদর্শনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য এই যে, বস্তুবাদীরা মানুষ ও বিশ্বের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য দৃশ্যমান বস্তুজগতকে চূড়ান্ত উপাদান মনে করে। কিন্তু ঐশী বিশ্বদর্শনে দৃশ্যমান বস্তুগত উপাদানের পাশাপাশি কিছু আধ্যাত্মিক কার্যকারণকে বিবেচনায় নেয়া হয় যা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইরানের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিক অধ্যাপক শহীদ মুর্তজা মোতাহারি এ সম্পর্কে বলেন, বস্তুগত চিন্তাদর্শন অনুযায়ী, জীবিকা, সুস্থতা, সুখ, মৃত্যু ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সম্পূর্ণভাবে বস্তুগত বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। শুধুমাত্র বস্তুগত কারণে মানুষের মৃত্যু আগে বা দেরিতে হয়, জীবিকা বৃদ্ধি  বা হ্রাস পায়, অসুস্থ হয় বা সুস্থ থাকে, সুখী হয় বা অসুখী থাকে।  এই বস্তুজগতে এবং দৃশ্যমাান জগতের বাইরে কোনো জগত থেকে এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু আত্মিক ও আধ্যাত্মিক জগত বলে অদৃশ্য যে জগত রয়েছে এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণে সেই জগতের বড় ভূমিকা থাকে। ইসলামি বিশ্বদর্শনে বলা হয়, আত্মিক কার্যকারণ বস্তুগত কার্যকারণকে প্রভাবিত করতে পারে। ইসলামের প্রাথমিক যুগের যুদ্ধগুলোতে মুসলিম বীর মুজাহিদদের বিজয়ের পেছনে এই আধ্যত্মিক কার্যকারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ইসলামি বিশ্বদর্শন অনুযায়ী, মহান আল্লাহ গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন। আসমানসমূহ ও জমিন এবং এই দুইয়ের মাঝখানে যা কিছু আছে তার সবকিছু আল্লাহর সৈনিক। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা সত্য ও ন্যায়কামীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন। অধ্যাপক শহীদ মোতাহারি বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চিন্তাদর্শনের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সম্পর্কে বলেন, একজন জড়বাদী মানুষ বিশ্বাস করে, মানুষ তার কর্ম ও পরিশ্রম অনুযায়ী ফল লাভ করে। কিন্তু একজন ঈমানদার মুসলমান বিশ্বাস করে, সে যদি আল্লাহ প্রদর্শিত পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় তাহলে এই বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে এমন একটি জগত আছে যেখান থেকে সে পৃষ্ঠপোষকতা পাবে। মানুষের চেষ্টা-প্রচেষ্টার চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি শক্তি সেই জগতে আছে এবং সেই জগতের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মানুষের চেষ্টার তুলনায় বহুগুণ বেশি ফল লাভ করা সম্ভব।

অধ্যাপক মোতাহারি মানুষের আচরণে এই বিশ্বাসের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, যারা আল্লাহ তায়ালার ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে তারা যেমন মৃত্যুর ভয় করে না তেমনি দরিদ্র হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তাদের মধ্যে থাকে না। ইসলামের প্রাথমিক যুগের ঈমানদার মুসলমানরা ছিলেন এ বৈশিষ্ট্যের মানুষের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।

হযরত ইমাম খোমেনী এ সম্পর্কে বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগের সৈনিকদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। কিন্তু তারা ইসলামের তৎকালীন দুই প্রধান শত্রু  ও  পরাশক্তি ইরান ও রোম সাম্রাজ্যের সুবিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছেন। এর কারণ তাদের ছিল আধ্যাত্মিক শক্তি। তারা প্রবল ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন এবং তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কাফির শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ হলেও আমরা সফল আর বিজয়ী হলেও সফল। ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের মনোবল ছিল এরকম বিশ্বাসে বলীয়ান।#

 

ট্যাগ