অক্টোবর ২৫, ২০২২ ২১:০১ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের প্রখ্যাত মনীষী কবি-সাহিত্যিক, গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়ামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা নিকট অতীতে ইরানের বেশ ক'জন মনীষীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা দেব।

আমরা 'ইরানে গণিতের ইতিহাস' নামক বইতে জানতে পারি মূলত গণিতের ইতিহাস ব্যবহারিক ও তাত্বিক এ দুই বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা গণিতশাস্ত্রে গ্রিক যুগের পর ইরানি যুগ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। বলে রাখা ভালো ইরানি যুগ বলতে মনীষীদের বেশিরভাগই ছিলেন ইরানি যদিও এদের মধ্যে বেশ ক'জন ছিলেন মিশরিয় গণিতবিদ। ইরানিরা গণিতের তিনটি অধ্যায় অর্থাৎ পাটিগণিত, অ্যালজেবরা ও ত্রিকোণমিতিতে  ছিলেন পারদর্শী। আমরা যদি হিজরি তৃতীয় থেকে পঞ্চদশ শতকের সব বড় বড় ইরানি গণিতবিদের পরিচয় তুলে ধরতে চাই তাহলে তা হবে অত্যন্ত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু প্রথম সারির মনীষীদের সম্পর্কে আলোচনা করতে  গেলে আলাদা বই রচনা করতে হবে। তাই আমরা বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে সীমিত সংখ্যক আরো কিছু ইরানি মনীষীদের জীবন বৃত্তান্ত ও গবেষণা কর্ম তুলে ধরার চেষ্টা করবো যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন।

ইরানের অন্যতম আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী হচ্ছেন আবুল ফাত্তাহ মাহমুদ বিন মুহাম্মদ ইস্পাহানি। তিনি ছিলেন হিজরি চতুর্থ শতাব্দির খ্যাতনামা অনুবাদক ও লেখক। তার রচিত 'মাখরুতাত আবু লুনিউস' গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এ ছাড়া, আবু জাফর খাজান খোরাসানি বীজগণিতে মাহানির সমীকরণকে কৌণিক ছেদনের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। গোলককে খণ্ড খণ্ড বিভক্ত করা নিয়ে যে পদ্ধতি ও প্রথার প্রচলন ইরাকের প্রখ্যাত গণিতবিদ আল্ মাহানী করেছিলেন তা ছিল অভিনব। গোলক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তিনি বীজগাণিতিক ত্রিমাত্রিক সমীকরণ আবিষ্কার করেন এবং এ সমীকরণ সমাধানে ত্রিকোণমিতির চিহ্ন ও ত্রিমাত্রিক কোনের সাইন ব্যবহার করেন। আল মাহানী 'কনিক'-এর সাহায্যে ত্রিমাত্রিক সমীকরণ সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইরানের আবু জাফর খাজান খোরাসানি বীজগণিতে মাহানির ওই সমীকরণকে কৌণিক ছেদনের মাধ্যমে সমাধান করেছেন।

হিজরি চতুর্থ শতাব্দিতে ইরানে গিলানের অধিবাসী আরেকজন গণিতবিদ আবুল হাসান কুশিয়ারি গিলির কথা উল্লেখ করা যায় যিনি গণিত বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া আবুল হাসান আলী বিন নাসাভি খোরাসানি যিনি ফার্সি ভাষায় পাটিগণিতের ওপর বই লিখেছিলেন যা পরবর্তীতে 'আল মাগনি ফি হেসাব আল হেন্দি' নামে আরবিতে অনূদিত হয়েছিল। তার বেশ কিছু বই জার্মানি ভাষায়ও অনুদিত হয়েছিল।

হিজরি তৃতীয় শতাব্দিতে বিখ্যাত খাওরিজমি ছাড়াও, আরেকজন প্রখ্যাত মনীষী ছিলেন আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইশহাক আল-কিন্দি। তিনি ছিলেন প্রথম ইসলামি দার্শনিক। আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইশহাক আল-কিন্দি আরবের বসরায় মেসোপটেমিয়ার নিকটবর্তী কুফা নগরীতে ৮০১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। আরব আদিবাসী  কিন্দা গোষ্ঠীর বংশভুক্ত ছিলেন। তিনি একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ, যুক্তিবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ ছিলেন। তারই ছাত্র আহমাদ সারখাছিও ভূগোল, মিউজিক ও জ্যোতির্বিদ্যা শাস্ত্রে ছিলেন পারদর্শী এবং তার যুগে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

ইরানের আরেকজন গণিতবিদ আবু আল ওয়াফা বুযজানির দুটি বই রয়েছে যেখানে তিনি মানুষ এবং মানুষের জীবন সম্পর্কে তার মতামত তুলে ধরেছেন। তার রচিত একটি বইয়ের নাম হচ্ছে 'যে জ্যামিতি কারিগরদের কাজে লাগবে'। তার আরেকটি বইয়ের নাম হচ্ছে 'যে গণিত হিসাব রক্ষকদের জন্য দরকারী'। তার লেখা ইরানি জ্যামিতির প্রথম খণ্ড ফার্সি ভাষায় অনূদিত হলেও দ্বিতীয় খণ্ডটি অনূদিত হয়নি। আবুল ওয়াফা বুযজানি অতীতের ইরানি ও গ্রিক বিজ্ঞানীদের অনেক বইয়ের ব্যাখ্যা লিখে গেছেন। যেমন, ইউক্লিডের 'প্রিলিমিনারিস' বা 'এলিমেন্টস' তথা প্রাথমিক বিষয়াদি ও উপাদান, খাওয়ারিজমির আল জাবর ওয়াল মুকাবেলা, টলেমির 'আলম্যাজেস্ট' ও দাওফান্তাসের 'যাব্‌র' শীর্ষক বইগুলোর অনুবাদসহ ব্যাখ্যা লিখেছেন বুযজানি। এ ছাড়া তিনি ত্রিকোণমিতি ও জ্যামিতিতে অনেক নতুন বিষয় যুক্ত করেছেন। যেমন, বৃত্তিয় বা গোলকীয় ত্রিভুজের ক্ষেত্রে সাইন কোনগুলোর সমীকরণ তথা সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন বুযজানি।

ইরানের আরেকজন প্রখ্যাত গণিতবিদ ছিলেন ইবনে সিনা। ফারাবির মতো তিনিও তার যুগে প্রচলিত ইরানি সঙ্গিতের কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করে এমনভাবে সংস্কার করেছিলেন যা আজো ইরানের সুন্নাতি বা ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। গাণিতিক পদ্ধতিতে লেখা বিখ্যাত 'শাফা' বইটি তিনিই উপহার দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক।

ইরানের আরেকজন মনীষী আবু বকর গোর্জি হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ক 'আল কাফি' বইটি লিখেছিলেন। এতে তিনি জ্যামিতিক চিত্র ব্যবহার না করেই পাটিগণিত সমাধানের উপায় বাতলে দেন। তিনি তার বইয়ে সংখ্যার পরিবর্তে শব্দের ব্যবহার করেছেন। তার 'হুওয়াফ হাইম' গ্রন্থটি জার্মানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আবুল হাসান নাসাভি ছিলেন ইরানের আরেকজন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। তিনি তার যুগে সাধারণ বিজ্ঞান ও গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর গবেষণা কর্মের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।  'আল-মাকনা ফী আল হিসাব আল হিন্দী' বইটিতে তিনি মহাকাশে নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান বিষয়ে ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।

গণিতের জগতে ইরানের আরেকজন উজ্জ্বল মুখ হচ্ছেন আলাগ বেগ। তিনি হচ্ছেন তৈমুরের নাতি। তিনি তৎকালীন ইরানের সামারকান্দ এলাকা শাসন করতেন। শাসক হলেও বিজ্ঞানের প্রতি তার ছিল প্রবল অনুরাগ। জিজুল্‌গ্‌ বেগ নামে জ্যোতির্বিদ্যার ওপর তার একটি গ্রন্থ রয়েছে। এ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি সময়ের বিভাজন, ক্যালেন্ডার ও মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ে এবং দ্বিতীয় অংশে সূর্যগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ গণনা, টেবিলের বিন্যাস এবং কীভাবে তা ব্যবহার করতে হবে সেসব বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন।

গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানি

নবম শতাব্দিতে ইরানের গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানি ছিলেন বিখ্যাত হিসাব বিজ্ঞানী, সংখ্যাতাত্বিক ও গণিতবিদ। তিনি ছিলেন দশমিক ভগ্নাংশের প্রকৃত আবিষ্কারক। কাশানির গণিতের বইয়ের নাম হচ্ছে মাফাতিউল হেসাব। তার এ বইটি ১৮৬৪ সালে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

ওই একই শতাব্দিতে একটি ঘটনায় আলাগ বেগ নিহত হওয়ার পর সমরকান্দের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র গণিতবিদ আলাউদ্দিন আলী কুশচি ইস্তাম্বুলে যান। আলাগ বেগের বইপত্র তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইস্তাম্বুলে গিয়ে তিনি তৎকালীন সুলতান মোহাম্মদ ওসমানিকে 'মাহমুদিয়ে' নামে একটি বই উপহার দেন। এ বইটি কাশানির লেখা মাফাতিউল হেসাব গ্রন্থের ভিত্তিতে লেখা হয়েছিল। তিনি প্রথম এ বইয়ে মাইনাস ও প্লাসের পরিভাষা ব্যবহার করেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ