অক্টোবর ২৭, ২০২২ ১৯:৫৫ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা নিকট অতীতে ইরানের বেশ ক'জন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আধুনিক ইরানের বেশ ক'জন চিন্তাবিদ ও গবেষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা দেব।

ইরানে সাফাভিয়ে রাজবংশের শাসনামল ছিল গণিতশাস্ত্রে তুলনামূলক সমৃদ্ধির শেষ পর্যায়। তবে এই যুগে ইরানে গাণিতিক কার্যক্রমের বিষয়ে বহির্বিশ্ব খুব কমই জানে। সাফাভি শাসনামলে ইরানে স্থাপত্য শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প ও কারুকার্য ব্যাপক সমৃদ্ধি ও বিস্তার লাভ করেছিল। ইরানের স্থপতি এবং প্রকৌশলীরা তাদের মেধা-মনন খাটিয়ে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সেতু নির্মাণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে গণিতেও তারা ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। দশম শতাব্দিতে সাফাভিয়ে শাসনামলে বাহাউদ্দিন অমলি গণিতের ওপর ব্যাপক গবেষণা ও কাজ করেছেন। গণিতের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি পূর্ববর্তী শিক্ষকদের লেখা ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিলেও স্থাপত্য নির্মাণ কাজে গাণিতিক হিসাব নিকাশে পুরানো পদ্ধতির অনেক সমস্যা কাটিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতি বের করেন। তৎকালীন সময়ের চিন্তাবিদ ও স্থপতি শিক্ষক পারভেজ শাহরিয়ার ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব।

পারভেজ শাহরিয়ার ফার্সি ১৩০৫ অর্থাৎ ইংরেজি ১৯২৬ সাল ইরানের কেরমান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞান কলেজে পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে অনার্স সম্পন্ন করেন। পারভেজ শাহরিয়ার ২০১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। জ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ইরানের অমর ব্যক্তিত্বদের একজন। তিনি একাধারে ছিলেন অনুবাদক ও লেখক। তিনি গণিত, সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ে ২০০টির বেশি বই অনুবাদ করেছেন। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে গণিতে দর্শন ও নীতিশাস্ত্র, পিথাগোরাসের পদাঙ্ক অনুসরণ, গণিতে সৃজনশীলতা, খাওরিজমি ও তথ্যবিজ্ঞান প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়। ইরানের এই শিক্ষাবিদ বলেছেন, 'গণিতের ইতিহাস ব্যবহারিক ও তাত্বিক এ দুই বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইরানিরা সবসময়ই গণিতের তিনটি অধ্যায় অর্থাৎ পাটিগণিত, অ্যালজেবরা ও ত্রিকোণমিতিতে ছিলেন পারদর্শী।'

দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো দেশের স্কুল ও বিশ্ববদ্যিালয়গুলোতে যদি বীজগণিতের তৃতীয় সমীকরণ নিয়ে কথা ওঠে তাহলে এটাকে ১৬ শ' শতাব্দির শেষের দিকে ইতালিয় গণিতবিদদের অবদান ও তাদের গবেষণার ফল বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ ইরানের খ্যাতনামা হিসাব বিজ্ঞানী, সংখ্যাতাত্বিক ও গণিতবিদ গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানির মৃত্যুর মাত্র একশত বছর পর ইতালি বিজ্ঞানীদের কথা ওঠে। যদিও কাশানির গবেষণার পদ্ধতি অনুমান নির্ভর কিন্তু   তার পদ্ধতির মাধ্যমে বীজগণিতের যেকোনো পছন্দসই স্তরে পৌঁছা সম্ভব।

দশমিক সংখ্যা ব্যবহারের পদ্ধতির জনক হিসেবে পাশ্চাত্যের গণিতবিদ সিমন স্টেভানের কথা উঠে আসে। অথচ তিনি ইরানের গণিতবিদ জামশিদ কাশানের মৃত্যুর ঠিক দেড় শ' বছর পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জামশিদ কাশানিই ছিলেন দশমিক সংখ্যার আবিষ্কারক। তিনিই প্রথম দশমিক সংখ্যা ব্যবহারের ধারণা তুলে ধরেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গণিতের ইতিহাসবিদরা এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন।

জ্ঞানের জগতে গণিত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী বিষয় বা মাধ্যম যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার জন্যও জরুরি। ওষুধ তৈরি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা কাজ থেকে শুরু করে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ণয় ও সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে গণিতের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। গণিত সবসময়ই অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে এবং বিজ্ঞানের উন্নয়ন বা বিকাশের পথকে আরা সহজ করে দেয়।

আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের দিকে একটু নজর দিলে এবং চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব যে এ বিশ্বে মানব সভ্যতার বিকাশে গণিতের অসামান্য অবদান রয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে বিভিন্ন জ্যামিতিক কাঠামো বা আকৃতি এবং উদ্ভিদের বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাজমান শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভবন নির্মাণ ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গাণিতিক হিসাব নিকাশের উপস্থিতি বিস্ময়কর। বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিধি বাড়ানো এবং গবেষণার ফলাফল বের করে আনা বা চূড়ান্ত ও নির্ভুল কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য বিজ্ঞানের বিভিন্ন  শাখার গবেষকরা গণিতের আশ্রয় নিয়ে থাকেন।    

প্রকৃতপক্ষে, গণিতশাস্ত্র প্রাচীন মানব সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মিশর এবং রোমান সভ্যতা থেকে পাওয়া প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনাবলী থেকে সেই যুগে গণিত ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া, ব্যাবেলিয়ন, গ্রিক, চৈনিক ও ভারতীয় সভ্যতার মতো প্রাচীন পারসিয়ান তথা আজকের আধুনিক ইরানের সভ্যতাও গড়ে উঠেছে গণিতের ওপর ভিত্তি করে। বিশেষ করে ইরানে বহু প্রাচীন কাল থেকেই গণিতের ওপর গবেষণা ও ব্যবহার হয়ে আসছে। ইরানে গণিতশাস্ত্রের অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছিল ইসলাম ধর্মের আগমনের পর। ইসলামের শিক্ষাকে ধারণ করে ইরানের মাটিতে আবু রেইহান বিরুনি, খাজা নাসির উদ্দিন তুসি, খাওয়ারিজমি, ইবনে সিনা, গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানি, ওমর খৈয়াম, শেইখ বাহাঈ প্রমুখ বড় বড় গণিত বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব ঘটেছিল। আজকের ইউরোপের উন্নতির পেছনে এইসব মনীষীদের বিরাট অবদান রয়েছে।

বর্তমান ইরানের অনেক চিন্তাবিদ ও গবেষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে গণিতশাস্ত্র এখনো ইরানের বুকে তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এমনকি ইরানের এমন অনেক গবেষক রয়েছেন যারা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত। 'জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান' শীর্ষক ধারাবাহিক এ অনুষ্ঠানের গত পর্বগুলোতে আমরা প্রাচীনকালে গণিতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি মনীষীদের পরিচিতি ও তাদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করেছি। পরবর্তী আলোচনাগুলোতে আমরা আধুনিক ইরানের খ্যাতনামা চিন্তাবিদ ও গবেষকদের অবদান ও গবেষণাকর্ম নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো। এরই অংশ হিসেবে আমরা আজ ইরানের একজন গণিতবিদ মরিয়ম মির্জাখনির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব। গণিত সম্পর্কে তিনি নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, 'গণিতের পেছনে যতবেশী সময় দিয়েছি ততবেশী উদ্বেলিত ও বিস্মিত হয়েছি'। তিনি তার সংক্ষিপ্ত জীবনের শেষ দিনগুলোতে ফেসবুকে দেয়া সর্বশেষ পোস্টে গণিত সম্পর্কে এই বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপিকা ছোটবেলা থেকেই গণিত ও জ্যামিতির প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫  জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ১২মে তার জন্ম হয়েছিল।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ