সুন্দর জীবন-১৬ (সময় ব্যবস্থাপনায় ৮০-২০ নীতি)
আজকের কাজ আগামীকালের জন্য কখনোই ফেলে রাখতে নেই। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)'র প্রিয় নাতি ইমাম হোসেন (আ.)'র একজন অনুসারীর নাম ছিল তারমাহ বিন হাকাম। ইমাম হোসেন (আ.) যখন কারবালা ও কুফার দিকে যাচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে ইমামের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। এ সময় ইমাম হোসেন (আ.) তাকে সফরসঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
কিন্তু তারমাহ বিন হাকাম তখনি সফরসঙ্গী না হয়ে তার কিছু কাজ সম্পন্ন করে ইমাম হোসেনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপর তিনি কাজ সেরে ইমামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য সেখানে গিয়ে দেখলেন- ইমাম হোসেন (আ.) শহীদ হয়ে গেছেন। এভাবে তিনি ইমাম হোসেন (আ.)-কে সহযোগিতা করার সুযোগ হাতছাড়া করেন। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.)-ও আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে না রাখতে মানুষকে পরামর্শ দিতেন। তিনি এক অনুসারীকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, বাকি জীবনকে কাজে লাগাও। আগামীকাল করব, পরশু করব-এসব বলো না। তোমার আগে এমন অনেকেই ধ্বংস হয়ে গেছে যারা নিজেদের খেয়াল-খুশির ওপর অটল থেকেছে এবং কাজ ফেলে রেখেছে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎই আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে চলে যেতে হয়েছে।
সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, কোন পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করেছে তা সময় ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলে। কোন কাজে কত সময় ব্যয় হবে তার অনেকটাই নির্ভর করে ঐ ব্যক্তি কাজটিকে কতটা পছন্দ করেন অথবা কাজটিতে কতটা মনোযোগ দিতে পারছেন। দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টা সবার কাছে সমান নয়। কেউ কেউ আছেন দিনের একটা বিশেষ সময়ে কাজে আনন্দ পান, স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। কাজে মনোযোগটাও তখন বেশি দিতে পারেন। এ কারণে দ্রুত কাজ সারতে পারেন। এ কারণে সবারই উচিত নিজের কাজের জন্য এমন উপযোগী সময় চিহ্নিত করে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করা। তাহলে স্বল্প সময়েই বেশি কাজ করা সম্ভব হবে। তবে এরও আগে আরেকটি কাজ করতে হবে। প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টা অথবা সপ্তাহের সাত দিন আপনি কীভাবে কাটাচ্ছি। কোন কাজে কতটুকু সময় দিচ্ছেন তা ভালোভাবে পরিমাপের চেষ্টা করুন। আপনি হয়তো ভাবছেন ইমেইল চেক করা অথবা ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে প্রতিদিন আপনার মাত্র ১৫ মিনিট সময় ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এমন নয়।
আপনি ভাবছেন সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে প্রতিদিন আপনার মাত্র ১৫ মিনিট সময় ব্যয় হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে প্রতিদিন আপনার এক ঘণ্টারও বেশি সময় সেখানে চলে যাচ্ছে। অনেকে আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে থাকছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি বুঝতেও পারছেন না যে, তিনি তার মহামূল্যবান সময় অগুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করে দিচ্ছেন। আপনি আসলে কতটুকু সময় এ ক্ষেত্রে ব্যয় করছেন তা পরিমাপের সহজ উপায় হচ্ছে কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা অ্যাপ ব্যবহার করা। আপনি এ ক্ষেত্রে রেসকিউ টাইম ও টুগলের মতো অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। ক্যালেন্ডারের সাহায্য নিতে পারেন। আপনি কোন কাজে কত সময় ব্যয় করছেন তা এসব অ্যাপের সাহায্যে সাহায্যে বের করতে পারবেন এবং এক সপ্তাহ এই কাজটি করলে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার সময় কীভাবে চুরি বা অপচয় হচ্ছে। এরপর সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য আপনি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারেন এবং সে অনুযায়ী এগোতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত 'পারেটো প্রিন্সিপাল' আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে।
ইতালির ভিলফ্রেডো ফেডেরিকো দামাসো পারেটো, টাইম ম্যানেজম্যান্ট আর প্রোডাক্টিভিটির এই নিয়ম উদ্ভাবন করেছেন। তার নামানুসারেই একে ‘পারেটোর ৮০-২০ নীতি' বলা হয়। পারেটো তার গবেষণায় দেখেছেন, ইংল্যান্ডের ২০ শতাংশ লোকের কাছেই ৮০ শতাংশ সম্পত্তি। আরও দেখেছেন যে, নিজের বাগানে ছিটানো ২০ শতাংশ মটরদানা থেকেই ৮০ শতাংশ চারা বেরিয়েছে। নীতিটা তাই এমন, ২০ শতাংশ চেষ্টা দিয়েই ৮০ শতাংশ ফল আসে। অবশ্য একদম অঙ্ক কষেই যে ৮০-২০ হবে, এমনটা নয়। ৮৫-১৫, ৯০-১০, ৯৫-৫—এ রকম অনেক কিছুই হতে পারে। আপনি কোনো ভাষায় দক্ষ হতে চাইলে ওই ভাষার কয়েক লাখ শব্দ আর ব্যাকরণ জানতে হবে না। মাত্র ২০ শতাংশ শব্দ দিয়েই আপনি ৮০ শতাংশ কথাবার্তা সারতে পারবেন। কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা রেস্টুরেন্টের অভিজ্ঞতা থেকেও জানা যায়, ২০ শতাংশ পণ্যই তাদের ৮০ শতাংশ বিক্রি এনে দেয়। আবার তাদের কেবল ২০ শতাংশ গ্রাহকই ৮০ শতাংশ অভিযোগগুলো করেন।
৮০-২০ নীতি আরেকটু স্পষ্ট করতে একটা উদাহরণ দিচ্ছি, আপনি খুব ভোরে উঠে পড়তে বসেছেন এবং সারাদিনে সব মিলিয়ে প্রায় ১০ ঘণ্টা পড়লেন। এখন দিনশেষে যদি আপনি হিসেব করতে বসেন তাহলে দেখতে পারবেন, সকালে উঠে প্রথম ২ ঘণ্টায় আপনার ভালো পড়া হয়েছে সারাদিনের বাকি ৮ ঘণ্টা থেকে। প্রথমের ওই ২ ঘণ্টায় আপনি বেশি মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন যার কারণে আপনার প্রোডাক্টিভিটি বা কাজের ভালো হয়েছে। অর্থাৎ আপনার সারাদিনের পড়ার ৮০ শতাংশ ভালো রেজাল্ট এসেছে মোট ব্যয়িত সময়ের ২০ শতাংশকে কাজে লাগিয়ে। আপনাকে সারা দিনের কাজকে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, কোন কাজগুলো আপনার সময় সবচেয়ে বেশি নষ্ট করছে। ঘন ঘন মেইল চেক, সব ফোন রিসিভ, মোবাইলের নোটিফিকেশনে নজর—এসবই পাবেন তালিকায়। দুপুর ১২টা আর বিকেল ৪টাতেই কেবল মেইলের উত্তর দিন। যেসব ফোন পরে কলব্যাক করলেও হবে, তা পারতপক্ষে রিসিভ করবেন না। স্মার্টফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করুন। নিজের মেধা-শ্রম দেবেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আগে শেষ করতে। অর্থাৎ ৮০-২০ নীতি ভালোভাবে অনুসরণ করার জন্য আপনাকে প্রতিদিন কী কী কাজ করেন তার একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। এবার খেয়াল করুন যে, আপনার লক্ষ্য পূরণে প্রতিদিনকার কোন কাজগুলো আপনাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে। সম্ভব হলে এই কাজগুলোই আগে সেরে ফেলুন।
আরেকটু স্পষ্ট করে বলছি, দিনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি কাজের তালিকা তৈরি করে ঠিক করুন এর মধ্যে ঠিক কোন কাজটি করলে পরিবার কিংবা কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। বাকি চারটি কেটে দিন এবং কেবল ওই কাজেই সবচেয়ে বেশি সময় দিন। যে ২০ শতাংশ পণ্য আপনাকে ৮০ শতাংশ আয় দিচ্ছে, এগুলোর মান বাড়াতেই মন দিন সবচেয়ে বেশি। বেশি গ্রাহক বা ক্লায়েন্ট মানেই সব সময় বেশি আয় নয়। যে ২০ শতাংশ গ্রাহক আপনাকে ৮০ শতাংশ লাভ দিচ্ছে, তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক গাঢ় করে আরও কাজ বা অর্ডার নিন। ছোট্ট একটি তালিকা করুন, কোন ২০ শতাংশ মানুষ আর কোন ২০ শতাংশ গ্রাহক কিংবা কাজ আপনার ৮০ শতাংশ মানসিক যন্ত্রণা-রাগ-সময় অপচয়ের কারণ। আর কোন ২০ শতাংশ এনে দিচ্ছে আর্থিক ও মানসিক তৃপ্তি।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।