অক্টোবর ৩১, ২০২২ ১৫:০৪ Asia/Dhaka

এবারে আমরা ইরানের একজন গণিতবিদ মরিয়ম মির্জাখনির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব। গণিত সম্পর্কে তিনি নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, 'গণিতের পেছনে যতবেশী সময় দিয়েছি ততবেশী উদ্বেলিত ও বিস্মিত হয়েছি'। তিনি তার সংক্ষিপ্ত জীবনের শেষ দিনগুলোতে ফেসবুকে দেয়া সর্বশেষ পোস্টে গণিত সম্পর্কে উপরিউক্ত এই বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপিকা ছোটবেলা থেকেই গণিত ও জ্যামিতির প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫  জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ১২মে তার জন্ম হয়েছিল।

শিশুকালের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মারিয়াম  মির্জাখনি বলেছেন, ইরানে আমার জন্ম এবং এখানেই বেড়ে উঠেছি। আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিজ্ঞানী বলতে কেউ ছিল না কিন্তু আমি আমার বড় ভাই যিনি বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রে খুবই দক্ষ ও আগ্রহী ছিলেন তার কাছ থেকে আমি গণিতের অনেক কিছু শিখেছি'। মারিয়াম  মির্জাখনি নারীদেরকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, 'তোমরা স্বাধীন থাকার চেষ্টা করো এবং নিজের পছন্দ কিংবা আগ্রহের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দাও। আমি দেখেছি একসময় ইরানের টেলিভিশনে মেরি কুরি ও হেলেন ক্লাবের মতো ব্যক্তিত্ববান ও প্রভাবশালী নারীদের বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো। আমি লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম এবং বিভিন্ন ধরনের গল্প, কাহিনী ও ইতিহাসের ওপর পড়াশোনা করতাম। কিন্তু এক পর্যায়ে গণিতের দিকে ঝুঁকে পড়ি'।

মারিয়াম  মির্জাখনি তেহরানের ফারজানেগণ এলাকায় একটি হাইস্কুলে পড়ালেখা করা অবস্থায় ১৯৯৪ সালে হংকং এবং ১৯৯৫ সালে কানাডা বিশ্ব গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।  তিনি ছিলেন প্রথম ইরানি ছাত্রী যিনি বিশ্ব গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেন এবং তিনিই প্রথম ইরানের গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। মারিয়াম  মির্জাখনি স্কুল জীবনেই উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এরপর তিনি ইরানের বিখ্যাত শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে সম্মানজনক স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আরো উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি প্রফেসর ম্যাকমুলেনের তত্ত্বাবধানে থেকে পড়াশোনার কাজ চালিয়ে যান এবং গণিতের বিভিন্ন শাখায় তিনি ব্যাপক আগ্রহী হয়ে পড়েন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে তিনি পিএইডি ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে ২০০৫ সালে মার্কিন বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী 'পপুলার সায়েন্স'এর পক্ষ থেকে দশজন সেরা তরুণ প্রতিভাবানদের মধ্যে একজন হিসেবে মারিয়াম  মির্জাখনি নির্বাচিত হন। গণিতেও তিনি সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশেষ সম্মান অর্জন করেন। এ ছাড়া, তিনি ২০১৩ সালে 'ম্যাথমেটিকাল সোসাইটি অফ আমেরিকা' থেকে কেলি অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৪ সালে গণিতের নোবেল খ্যাত 'ফিল্ডস মেডেল' পদক পান। বিজ্ঞানের মূল বিষয়ে গবেষণা এবং অব্যাহতভাবে কৃতিত্ব অর্জনের জন্য প্রথম ইরানি নারী হিসেবে ২০১৬ সালের মে মাসে মার্কিন ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস বা নাসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তিনি ২০০৮ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি গণিতের ওপর আরো ব্যাপক গবেষণাও চালিয়ে যান। এর আগে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষাদান করে। মারিয়াম   মির্জাখনি ২০০৯ সালে গণিতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য 'ব্লুমেন্থল' পুরস্কার জিতেছিলেন।    

মারিয়াম মির্জাখনির পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে 'ম্যাথমেটিকাল সোসাইটি অফ আমেরিকা'র জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, 'গণিতে ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতা, একটি উদ্ভাবনী ডক্টরাল থিসিস এবং হাইপারবোলিক জ্যামিতি থেকে অটোমরফিক ফর্ম ও সিমপ্লেটিক জ্যামিতির ওপর নতুন তত্ব দাঁড় করার কারণে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এই তিনটি জ্যামিতিক পদ্ধতিকে সমন্বয় করার কৌশল তিনি বের করেন'।

উল্লেখ্য, হাইপারবোলিক জ্যামিতিতে একক রেখাগুলিতে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতিতে একক সরল রেখার সমান বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হাইপারবোলিক জ্যামিতির জগতটা একেবারেই অন্যরকম। হাইপারবোলিক জ্যামিতিতে সমান্তরাল রেখা মিশে যায়, আবার সরলরেখা দেখায় আঁকা বাঁকা। সেকারণে খুবই জটিল এই হাইপারবোলিক জ্যামিতির দুনিয়াটাকে দেখা হয় গণিতের আয়নায়।

মারিয়াম  মির্জাখনি

গণিতবিদদের মধ্যে মারিয়াম মির্জাখনি এ জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে তিনি ছিলেন অদম্য ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন সমস্যা বা প্রশ্নগুলোকে গভীর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক কার্টিস ম্যাকমুলেন তার সম্পর্কে বলেছেন, 'গণিতের যে কোনো বিষয় তার সামনে এলেই তিনি এর নাড়িনক্ষত্র উদ্ধারের জন্য উঠেপড়ে লাগতেন এবং শেষ না করা পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হতেন না'।

প্রকৃতপক্ষে, মারিয়াম মির্জাখনি যেমন ছিলেন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী আবার একই সাথে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। উদাহরণ স্বরূপ, গণিতের যে কোনো জটিল সমস্যা সমাধানে তার অবদান সম্পর্কে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি খুবই সরল মনে বলতেন সত্যি বলতে কি ওই বিষয়ে সমস্যা সমাধানে আমার অবদান তেমন কিছু নয়। তিনি নিজেকে বড় করে তুলে ধরতে না চাইলেও অন্য গণিতবিদরা গণিত সমস্যা সমাধানে মারিয়াম মির্জাখনির দক্ষতার জন্য ঠিকই তার প্রশংসা করতেন।

মির্জাখনির সহকর্মী ও শিকাগোতে অবস্থানকারী গণিতবিদ অ্যালেক্স এস্কিন তার সম্পর্কে বলতেন, হাইপারবোলিক জ্যামিতিক আকৃতির পৃষ্ঠের ওপর লুপস্‌ (loops) গণনা সম্পর্কে তার পিএইচডি থিসিস ছিল খুবই আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর এবং গণিত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে তার এ সংক্রান্ত গবেষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির যোগ্য'।

যাইহোক, ২০০৬ সালে মির্জাখনি জ্যামিতির একটি জটিল সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হওয়ায় তিনি সবার নজর কেড়েছিলেন। এ ছাড়া, একটি বিলিয়ার্ড টেবিলে সাজানো বহুভুজ আকৃতির বলগুলোর গতিবিধি কি হবে কিংবা বলগুলো কোনটা কোনদিকে যাবে তা আগে থেকে ধারনা পাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। আজ থেকে এক শ' বছর আগে গণিতবিদরা এ সমস্যার একটা সহজ সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রায় ১০০ বছরে এই সমস্যার সহজ কোনো সমাধান মেলেনি। কিন্তু ২০১২ ও ২০১৩ সালে এসে মারিয়াম মির্জাখনি তার দুজন সহযোগীসহ ওই সমস্যার সমাধান বের করছিলেন।

এ ছাড়া, ২০১৩ সালে 'সাইমন্স স্কলারস অ্যাওয়ার্ড' বিজয়ী ১৩ জন ব্যক্তির মধ্যে মারিয়াম মির্জাখনি এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গণিত শিক্ষকের নাম ছিল। ২০১৪ সালে তিনি 'ফিল্ডস মেডেলস' জিতেছিলেন যা ছিল গণিতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরস্কার। ফিল্ডস পদক অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়সী দুই, তিন বা চারজন গণিতবিদকে প্রদানকৃত একটি পুরস্কার যা প্রতি চার বছর অন্তর আন্তর্জাতিক গণিত প্রতিযোগিতায় দেয়া হয়। এটিকে গণিতের নোবেল হিসেবে দেখা হয়। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা গণিতবিদ এবং প্রথম ইরানি নারী যিনি 'ফিল্ডস মেডেলস' জিতেছিলেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ