'আমেরিকার দম্ভ চ্যালেঞ্জ করে ইরানের ছাত্ররা মার্কিন দূতাবাস দখল করেছিল'
ইরানে গতকাল পালিত হয়েছে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া বা মার্কিন দূতাবাস দখলের বার্ষিকী। এ উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ড.তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান গতকাল রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর ছাত্র যুবকরা তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখল করে। এরফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দম্ভ, অহঙ্কার এবং ক্ষমতায় একটি বড় ধরনের আঘাত তৈরি হয়, বড় একটি প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। আর সেই ঘটনার প্রভাব পরবর্তীতে ইরানের রাজনীতিতে যেমন আছে ঠিক তেমনি এটির একটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্যও তৈরি হয়।
বিশিষ্ট এই রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, সেদিনের সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আজও আমরা দেখছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপরে একের একের এক অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমেরিকার সেইসব নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবেলা করে ইরান টিকে আছে আত্মমর্যাদা নিয়ে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, প্রতিবছর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ৪ নভেম্বর মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া বা মার্কিন দূতাবাস দখলের বার্ষিকী পালন করা হয়। ইরানিরা বিষয়টিকে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া দখল হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ড.তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান: ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর কিছু ছাত্র তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখল করে। আর সেই দখলের সূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দম্ভ, অহঙ্কার এবং ক্ষমতা নিয়ে তাদের যে আস্থা-তাতে একটি বড় ধরনের আঘাত তৈরি হয়, বড় একটি প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। আর সেই ঘটনার প্রভাব পরবর্তীতে ইরানের রাজনীতিতে যেমন আছে ঠিক তেমনি এটির একটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্যও তৈরি হয়। মার্কিন দূতাবাস দখলের ৪৪৪ দিনের মাথায় মার্কিন দূতবাসের কর্মীদেরকে ইরান আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করে ২০ জানুয়ারি১৯৮১ সালে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঐ ঘটনার একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত তাৎপর্য ছিল।
রেডিও তেহরান: ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া দখলের ঘটনায় মূলত ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে- ছাত্রদের সেই পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারি যে ফল তাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড.তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান: ছাত্রদের নেতৃত্বে তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখলের প্রেক্ষাপটে ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তো বটেই সারা বিশ্বজুড়ে এর একটি বড় প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
৪৪৪ দিনের সেই জিম্মি ঘটনায় বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক অনেক কার্যক্রম তৈরি হয়। তার ফলাফল হচ্ছে ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদেরকে ইরান ফেরত দেয়। সেই চুক্তিতে যেমন ৫২ মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল একইসাথে আমেরিকা অঙ্গীকার করেছিল যে তারা আর ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না বা হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু তারা সেই কথা রাখেনি। তারা ইরানিদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশটির আটকে দেয়া ৮ বিলিয়ন সম্পদ ফেরত দেবে। কিন্তু আমেরিকা সেইসব চুক্তির কোনটিই পরে রক্ষা করেনি।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং ইরানের জাতীয় স্বার্থে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার সাহস সেদিনের সেই ছাত্র যুবকেরা দেখিয়েছিল পরবর্তীতে আমরা দেখি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা রূপকার ইমাম খোমেনী (র.) যুবকদের সেই উদ্যোগকে অনুমোদন দিয়েছিল। এটি ছিল ইরানের ভেতরগত আয়োজন কিন্তু ইমাম খোমেনী (র.) অনুমোদনে সেটি ইরানি জনগনের মধ্যে যথেস্ট উদ্দীপনা তৈরি করে। এটি একটি দিক।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে কারও কাছে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে পারে, প্রতিবাদের মুখে পড়তে পারে সেটি আমরা ঐ ঘটনার মাধ্যমে দেখলাম। আমেরিকা তাদের নাগরিকদের ছিনিয়ে নেওয়া এবং উদ্ধার করার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সেসব উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব চেষ্টায় ইরানে আটক তাদের নাগরিকদেরকে ফিরিয়ে নিতে পারেনি। আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে সেটি সম্পন্ন হয়। আর সেই যে পরাজয় তার প্রতিশোধ নিতে আজও আমরা দেখছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপরে একের একের এক অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমেরিকার সেইসব নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবেলা করে ইরান টিকে আছে আত্মমর্যাদা নিয়ে।
রেডিও তেহরান: বিপ্লবকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে এই ঘটনা বিশেষ কোনো ভূমিকা পালন করেছে বলে কি আপনার মনে হয়?
ড.তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান: দেখুন, সে সময় ইরানের সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিপ্লবের অস্থায়ী রাজনৈতিক সরকার শক্তিশালী অবস্থান নিতে যে দ্বিধা করছিল তেমনি একটি অব্স্থায় ইমাম খোমেনী (র.) এর চিন্তায় ও আদর্শে উদ্ধুব্ধ কিছু ছাত্র যুবক মার্কিন দূতাবাস দখলের সেই উদ্যোগটি নিয়েছিল। আর তখনই বিশ্ববাসী ঐ ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে। ঐ ঘটনাটি মার্কিন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ইরানি জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করে, ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের ঐক্যকে সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল।
রেডিও তেহরান: দূতাবাস দখলের ঘটনায় আমেরিকার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেল। প্রশ্ন হচ্ছে- ইরান কি সেই সময় মার্কিন দূতাবাস দখল না করে কূটনৈতিক পন্থায় আরো কি কিছু করতে পারতো?
ড.তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান: দেখুন, সাধারণ বিবেচনায় অন্যদেশের দূতাবাস দখলের কোনো উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়; শোভনও নয়। কিন্তু সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে সংহত করার জন্য, ইসলামি বিপ্লবকে যেকোনো সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে মুক্ত করার জন্য অনেকের মধ্যে মনোযোগ ছিল। তখন জিমি কার্টার সরকার ক্ষমতাচ্যুত পালিয়ে যাওয়া রেজা শাহ পাহলভীকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেয়। সেটি ইরানি জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে যে তারা ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে চায় এবং মোহাম্মাদ রেজা শাহ পাহলভীকে আবারও ক্ষমতায় বসাতে চায়। এমন একটি গভীরতর দ্বিধা এবং আশঙ্কা থেকে ইরানি ছাত্র-যুবকরা মার্কিন দূতাবাস দখলের উদ্যোগ নেয়। তবে এমন একটি উদ্যোগ তখনকার রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে নেয়া কঠিন ছিল; প্রায় অসম্ভব ছিল। সেই কাজটি সরকারের অগোচরে ইমাম খোমেনীর চিন্তা আদর্শে উদ্ধুদ্ধ ছাত্র যুবকরা সেই কাজটি করেছিল। সুতরাং বিষয়টি এই বিবেচনায় দেখা উচিত যে এটি একটি অঘোষিত এবং অপরিকল্পিত উদ্যোগ। কিন্তু এটি একটি সফল উদ্যোগ। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাময়িকভাবে হলেও তাদের কর্তৃত্ব ঔদ্ধত্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলা গেছে।ফলে মার্কিন দূতাবাস দখলের একটি সফল ঘটনা হিসেবে ৪ নভেম্বর বিশ্ব ইতিহাসে থেকে যাবে।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৫