ডিসেম্বর ০৫, ২০২২ ১৫:৫৯ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা আলোকবিদ্যা ক্ষেত্রে বিখ্যাত মুসলিম মনীষী ইবনে হাইসামের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা মহান এ মনীষীর অন্যান্য গবেষণাকর্ম সম্পর্কে আলোচনা অব্যাহত রাখব।

যদিও ইবনে হাইসাম তার মতামত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের যেমন টলেমি ও ইউক্লিডের মতামতকে ব্যবহার করেছেন কিন্তু এটা স্পষ্ট বলা যায় অপটিক্যাল বা আলোকবিদ্যা বিষয়ে তার চিন্তাভাবনাগুলো একেবারেই তার নিজস্ব এবং পূর্বসূরিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু নয়। কেননা তার পূর্বে গ্রিক কিংবা মুসলিম মনীষীদের মধ্যে এ সংক্রান্ত গবেষণা হয়নি। ইবনে হাইসাম অনেক বিষয়ে গ্রীকদের মতামত সংশোধন ও সংস্কারক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর রচিত আল-মানাযার গ্রন্থসহ অন্যান্য লেখায়ও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আলোক বিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত ইবনে হাইসামের অসামান্য অবদানের কারণে আজ আমরা ছবি তোলার যন্ত্র, ভিডিও করার যন্ত্র বা ক্যামেরা, সিনেমা প্রদর্শনের জন্য প্রজেক্টর প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছি। তিনি আলোকবিদ্যার উপর একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন এবং ম্যাগনিফাইং গ্লাস তারই তৈরি। ইবনে হাইসাম আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণের মধ্যে অনুপাত নির্ণয় করেন এবং অন্ধকার কক্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি অনেক গবেষণা ও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এ ছাড়া,  তিনি চোখের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে ইবনে হাইসামের প্রায় ২০টি গ্রন্থ রয়েছে। তবে তার খ্যাতির প্রধান কারণ 'মাকালে ফি হায়াত আল অলাম' গ্রন্থের কারণে। এটি ছিল তার প্রথম দিকের রচনাগুলোর মধ্যে একটি। চোখ থেকে যে আলোক রশ্মি বের হয় তার ওপরেই মূলত এ বইটিতে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি চাঁদকে এমন একটি মসৃণ দেহের সাথে তুলনা করেছেন যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে। ইবনে হাইসামের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত আল-মানাযার গ্রন্থটি মধ্যযুগে পশ্চিমে নিয়ে যাওয়া হয়। আব্রাহাম হেব্রায়ুস ১৩শ' শতাব্দীতে ক্যাস্টিলের রাজা আলফোনসাভির নির্দেশে এটিকে স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। এই অনুবাদটি একজন অজানা অনুবাদক 'বুক অফ দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড দ্য স্কাই' শিরোনামে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।  এ গ্রন্থে ইবনে হাইসাম সূর্য থেকে চাদের আলো গ্রহণ এবং পৃথিবীতে তার প্রতিফলন বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কয়েক শতাব্দি ধরে এ বইটি ইউরোপের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

আলোকবিদ্যা নিয়ে ইবনে হাইসামের গবেষণা

অন্ধকার ঘর ও সেটাতে আলো প্রবেশের মাধ্যমে ছবি তোলার অভিনব কৌশল আবিষ্কার করেন ইবনে হাইসাম বাসরি।

তার এ আবিষ্কারের ফলেই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তৈরি হয়েছিল। তিনি সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের জন্য 'অবস্কিউরা  ক্যামেরা' উদ্ভাবন করেন এবং পরিবর্তীতে এ সংক্রান্ত বিদ্যা ও যন্ত্রপাতি ক্রুসেডের যুদ্ধের সময় ইউরোপে প্রবেশ করে। ইবনে হাইসামের এ সংক্রান্ত গবেষণা কর্ম ও আবিষ্কার ইউরোপের আলোকচিত্র শিল্পীদের কাছে অনেক গুরুত্ব পায়। ১৬শ' শতাব্দিতে ইতালির বহু চিত্রশিল্পী সঠিক চিত্রাঙ্কন ও নকশা তৈরি এবং দূরের বস্তু দেখার জন্য এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন।

মোটকথা, ইবনে হাইসাম ছিলেন ফটোলজির জনক। ফটোলজি বিদ্যাকে তিনি সুশৃঙ্খল রূপ দেন। আলো নিয়ে এবং ছায়া নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। অন্ধকার কক্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি অনেক গবেষণা করেছেন। একইভাবে তিনি আলোর প্রতিফলনের নিয়মের ক্ষেত্রে চমৎকার কিছু গবেষণা করেছেন।

ফটোলজি এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ইবনে হাইসামের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই এখনো পাওয়া যায়। তাঁর লেখা আল-মানাযার বইটি ল্যাটিনে অনুদিত হবার পর সেই মধ্যযুগে এটি পশ্চিমা বিশ্বে ফটোলজি এবং পদার্থবিজ্ঞানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তবে ইবনে হাইথামের পর মুসলিম বিশ্বে ফটোলজি বিদ্যা চর্চায় আগ্রহ কমে যায় এমনকি খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির মতো বড়ো বড়ো মনীষীও ইবনে হাইসামের অবদান সম্পর্কে ততোটা অবহিত ছিলেন না। তবে পরবর্তীকালে অর্থাৎ হিজরী সপ্তম শতাব্দিতে ফটোলজি নিয়ে পুনরায় চর্চা শুরু হয় এবং কুতুব উদ্দিন শিরাযি ফটোলজির একটি শাখাকে ইরানে ব্যাপকভাবে প্রবর্তন করেন। আধুনিক পাশ্চাত্যে ফটোলজি নিয়ে যতোটা চর্চা হচ্ছে তা বহুলাংশেই ইবনে হাইসামের মতো মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কাছে ঋণী। এ কারণেই পাশ্চাত্যে ইবনে হাইসামকে ফটোলজির জনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রজার বেকনও পরিপূর্ণভাবেই ইবনে হাইসামের প্রভাবে ভীষণরকম প্রভাবিত ছিলেন।

ইবনে হাইসামের লেখা 'কিতাব আল-মানাযার 'গ্রন্থকে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সমকক্ষ ধরা হয়। তার সাত খণ্ডে প্রকাশিত এই বইটি আলোকবিজ্ঞান সম্বন্ধে সমসাময়িক তো বটেই, পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনে। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর উপর পড়লে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। এই ধারণাটি ছিল অ্যারিস্টটলের। কিন্তু ইবনে হাইসাম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটি ভুল প্রমাণিত করেন। যেমন, বহুদূরের তারকারাজি আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই। আমাদের চোখের আলো কতটা শক্তিশালী যে এতো পথ মূহুর্তেই পাড়ি দিয়ে সে তারকার কাছে পৌঁছে যায়? তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ঘোষণা করলেন কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলে তবেই আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়েও পরীক্ষা করেন।

ইবনে হাইসাম 'কিতাব আল-মানাযির' ছাড়াও আলোকবিজ্ঞানের উপর ‘রিসালা ফিল-দাও' বা ‘ট্রিটিজ অব লাইট' রচনা করেন। এখানে তিনি আলোর প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, গ্রহণ, রংধনু, অধিবৃত্তিক কাঁচ, বিবর্ধন কাঁচ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। চোখের জৈবিক গঠন ও ব্যবচ্ছেদ বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি আলো বিষয়ক এতো গবেষণা করেন যে সেগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করতে গেলে একাধিক প্রবন্ধের প্রয়োজন হবে।

ইবনে হাইসামের মোট গ্রন্থের সংখ্যা ২০০টির বেশি, যার মধ্যে ৯৬টি বৈজ্ঞানিক। তবে সেসবের মধ্যে বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ৪৬টি। তারপরও ৪৬টি গ্রন্থ তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন গবেষক, পর্যবেক্ষক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে। বর্তমানে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের নিকট যে মুসলিম বিজ্ঞানীর নামটি সবচেয়ে জনপ্রিয় তা হচ্ছে ইবনে হাইসাম যিনি পাশ্চাত্যে ‘আল হ্যাজেন' বা আল হাইথাম নামেও পরিচিত।#

 পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ