ডিসেম্বর ২৬, ২০২২ ২১:০৩ Asia/Dhaka

শরীরের কমপক্ষে ১৮ শতাংশে রোদ পড়তে দিতে হবে ভিটামিন ডি'র জন্য। সাধারণ ত্বকের জন্য ১০ থেকে ১৫ মিনিট এবং কালো ত্বকের জন্য ৪০ মিনিট থেকে একঘন্টা সূর্যের আলো লাগাতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে পুরুষদের খুব বেশি ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (Erectile dysfunction) থাকে। ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শীথিলতার সাথে ভিটামিন ডি এর গভীর সম্পর্ক আছে। শুধু তাই নয় 'ম্যাল অ্যাবজর্বশন সিনড্রোম' বা বদজমের সাথেও ভিটামিন ডি'র সম্পর্ক আছে।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। ভিটামিন ডি এর ঘাটতির ফলে যেসব রোগ্যব্যাধী হয় তা এবং করণীয় নিয়ে কথা আমাদের আলোচনার আজ তৃতীয় পর্ব। আর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা বিএসএমএমইউ এর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ এর সহযোগী অধ্যাপাক ডা.শাহজাদা সেলিম। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক টেক্সিলা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক।

সাক্ষাৎকারে যাওয়ার আগে ভিটামিন ডি সম্পর্কে দুটো কথা বলে রাখি। মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো ভিটামিন 'ডি'। ভিটামিন 'ডি' অস্থি ও দাঁতের কাঠামো গঠন করে। অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ায়, রক্ত প্রবাহে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ভিটামিন ডি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর অভাবে নানাধরণের রোগ হতে পারে এবং তা কখনও কখনও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তো চলুন ভিটামিন ডি ঘাটতি সম্পর্কিত  তৃতীয় পর্বের আলোচনায় যাওয়া যাক।

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম, রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম, দ্বিতীয় পর্বের শেষ প্রশ্ন ছিল ভিটামিন ডি এর যে অভাব  আছে সেটা আমরা কি করে বুঝব? সাধারণ মানুষ আপনাদের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত বাইরে থেকে সে বুঝতে পারবে যে তার ভিটামিন ডি এর অভাব রয়েছে? সময় স্বল্পতার কারণে  এ সম্পর্কিত আলোচনা শেষ করা সম্ভব হয়নি। তো আজকের আসরের শুরুতে  আপনি ঐ বিষয়টি বলুন, যে ভিটামিন ডি এর অভাব রয়েছে  তা কিভাবে বুঝব?

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: ভিটামিন ডি স্বল্পতার ব্যাপারে আমরা দেখেছি বেশিরভাগ রোগী যেসব লক্ষণ নিয়ে আমাদের কাছে আসেন তখন দেখা যায় তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা। আর এই ব্যথার জন্য রোগী হয়তো কিছু ব্যথা নাশক ওষুধ খেয়েছেন কিন্তু তাতে খুব বেশি ফল পাননি। তারপর আমরা যখন ঐসব রোগীদের ভিটামিন ডি এর মাত্রা পরীক্ষা করি এবং ভিটামিন ব্যবহার করতে বলি। ভিটামিন ডি ব্যবহারের ফলে রোগীর সেইসব লক্ষণ দ্রুত দূর হয়ে যায়। আবার অবসাদগ্রস্ত মানুষগুলোর ভিটামিন ডি এর ঘাটতি আছে কি না তা বোঝা কিন্তু বেশ মুশকিল হয়ে যায়। অবসাদের কারণে রোগী নিজেও হয়তো বুঝতে পারে না বা বলতে পারে না যে তার ভিটামিন ডি ঘাটতি আছে। তাদের পরীক্ষা করলে দেখা যায় ভিটামিন ঘাটতি রয়েছে।

 এ বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উল্লেখ করছি। গত দুমাস আগে  বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস রোগীদের  মধ্যে পুরুষদের খুব বেশি ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (Erectile dysfunction) থাকে। ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শীথিলতা হচ্ছে- এমন একটি পরিস্থিতির যখন কোনও পুরুষের লিঙ্গের দৃঢ়তা বা ঋজুতা বা একটি শক্ত লিঙ্গ পেতে অসুবিধা হয়, যা যৌন অনুপ্রবেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বেশ কিছু ক্ষেত্রে একটি মানুষের মধ্যে পুরুষত্বহীনতার কারণ হতে পারে।

 আর এক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর মাত্রার সাথে গভীর সম্পর্ক থাকে। যখন পুরুষ ইরেক্টাইল ডিসফাংশন নিয়ে আসেন তাদের রোগটি যখন আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করি তখন ভিটামিন ডি'র মাত্রা যদি কম থাকে তখন চিকিৎসার অংশ হিসেবে ভিটামিন ডি প্রেস্ক্রাইব করি। তাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

রেডিও তেহরান:আচ্ছা অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম, দেখা গেল কোনো একটি রোগে ভুগছেন। তারসাথে  ভিটামিন ডি এর ঘাটতির লক্ষণ আছে কি নেই সেজন্য রোগীকে কি অপেক্ষা করা উচিত?

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: দেখুন, ভিটামিন ডি ঘাটতির সুনির্দিষ্ট লক্ষণের জন্য অপেক্ষা করায় কিন্তু সমস্যা হতে পারে। আপনার এই প্রশ্নের সাথে মিলে যাবে এমন আরেকটি বিষয় তুলে ধরছি। মেডিক্যাল কলেজের একটি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল ২৮ জন। তাদের পরীক্ষা করে দেখা গেল যে সবার মধ্যে ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা আছে। তাদের কিন্তু দৃশ্যমান কোনো রোগ ছিল না। তাদের যখন ভিটামিন ডি ব্যবহার করতে বলা হলো এবং তারা এটি ব্যবহারের পর বুঝতে পারল যে এটিতে তাদের লাভ হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণগুলো এত দুর্বল ছিল যে বোঝা যায়নি। কিন্তু ফলাফলটা তাদের কাছে বিদ্যমান হলো।

ভিটামিন ডি এর ঘাটতি ও করণীয় সম্পর্কে এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিমের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম স্বাস্থ্যকথার আলোচনায়। ডা. শাহজাদা সেলিম- ভিটামিন ডি এর ঘাটতির ব্যাপারে বয়সভেদে কিংবা লিঙ্গভেদে কি পার্থক্য আছে?

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: জ্বি অবশ্যই পার্থক্য আছে। খুব বেশি বয়সী মানুষদের মধ্যে ভিটামিন ডি ঘাটতির সম্ভাবনা বেশি। কারণ তারা সাধারণত ঘরে থাকে। পৃথিবীর সব দেশে  এরকমই দেখা যায়। আবার যেসব দেশে সূর্যের আলো কম পাওয়া যায় সেসব দেশের বয়স্ক মানুষদের মধ্যে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি আরো বেশি।

আবার খুব কম বয়সী যারা মায়ের বুকের দুধের ওপরই প্রধানত নির্ভরশীল। একটু একটু করে খাদ্যভ্যাস তৈরি হচ্ছে তাদের মধ্যেও কিন্তু ভিটামিন ডি ঘাটতির সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার যদি অন্য কোনো রোগ থাকে- সেক্ষেত্রে ধরুন আমরা যে খাবার খাই তাতে ভিটামিন ডি খুব বেশি পাওয়া যায় না। তারপরও যেটুকু খাই-সেটুকুও গ্রহণ করতে বাধা তৈরি করে যাকে বলে 'ম্যাল অ্যাবজর্বশন সিনড্রোম'  বলা হয়।  অর্থাৎ খবারটি হজমের প্রক্রিয়ার মাঝখানে বাধা তৈরি করে।

আবার ধরুন কাজের ধরন অনুযায়ী বাংলাদেশে যারা গার্মেন্টে চাকরি করে তারা দিনের বেলায় ফুল টাইম কারাখানায় থাকে। সেখানে সূর্যের আলো পায়না। সেনাবাহিনীসহ আরও কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে বাইরে কোনো কাজ করে না। যেমন ধরুন- জেলখানার কয়েদিরা। তাদের রোদে যাবার সুযোগ কম। এগুলো হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপ। আবার যাদের শরীর বেশি করে আবৃত থাকে তাদেরও ভিটামিন ডি ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। সূর্যের আলোটা কিন্তু সরাসরি শরীরে পড়তে দিতে হবে।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম- ভিটামিন ডি পাওয়ার সবচেয়ে বড় উৎস যে সূর্যের আলো- যদি কেউ সানক্রিম মেখে সূর্যের আলোতে যায় কিংবা কেউ যদি গ্লাস আটা গাড়ির ভেতর থেকে রোদ পোহায়-সে কি ভিটামিন ডি পাবে?

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: কেউ যদি সানক্রিম মেখে সূর্যের আলোতে যায় কিংবা কেউ যদি গ্লাস আটা আলট্রাভায়োলেট রে প্রট্কেটেড গাড়ির ভেতর থেকে রোদ পোহায় তাহলে তাতে কোনো কাজ হবে না। তাহলে আবৃত অংশটা ভিটামিন ডি পেতে বাধা তৈরি করে। আঠারো শতাংশের বেশি রোদ পড়তে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে মুখের পুরো অংশ, হাতের বেশিরভাগ জায়গা, পায়েরও বেশিরভাগ জায়গায় রোদ পড়তে দিতে হবে। এরা কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপ তৈরি করছে।

আগেও বলেছি আরেকটি বিষয় সেটি হচ্ছে ত্বকের রং। ত্বকের রং যতবেশি কালো হবে সেই ত্বককে ভেদ করে আল্ট্রাভায়েলেট রশ্নি  ভেতরে ঢোকার ক্ষেত্রে তত বেশি বাধা তৈরি করবে। ফলে একেক জায়গায় কিন্তু একেক রকম বিষয় কাজ করছে। বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু অনেক বেশি কৃষ্ণ নয় তারপরও কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভিটামিন ডি'র ঘাটতি অনেক বেশি। ইরানের সাম্প্রতিক একটি গবেষণার কথা বলছি। সেখানে দেখা গেছে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশের মধ্যে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়েছে। আর মহিলাদের প্রায় ৬৭ শতাংশ ভিটামিন ডিএর ঘাটতিতে আছে। ফলে ভিটামিন ডি স্বল্পতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ এবং বয়সভেদে পার্থক্য আছে।

রেডিও তেহরান: অনুষঙ্গ ধরেই একটা বিষয় জানতে চাইছি, আপনি গায়ের রংয়ের কথা বললেন অর্থাৎ যাদের শরীরের চামড়ার রং কালো তাদের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপায় থেকে ভিটামিন পাওয়ার ব্যাপারে বাধাগ্রস্ত করে-এইতো?

অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম: জ্বি। অর্থাৎ মেলামিন যেটা থাকে সে আল্ট্রাভায়োলেট রে কে চামড়ার ভেতরে ঢুকতে দেয় না।সেক্ষেত্রে যেটি করতে হবে সেটি হচ্ছে- আমি আগেই বলেছি যে শরীরের কমপক্ষে ১৮ শতাংশ রোদ পড়তে দিতে হবে। আর এজন্য কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রোদে থাকতে হবে। যার শরীরের ত্বক যত বেশি কালো তাকে তত বেশি অর্থাৎ ৪০/৫০ মিনিট কিংবা একঘণ্টা রোদে থাকতে হবে।#

তো অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম- ভিটামিন ডি এর ঘাটতি নিয়ে সৃষ্ট রোগ সম্পর্কিত আলোচনার রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৬

ট্যাগ