জানুয়ারি ০৮, ২০২৩ ২১:০৯ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের খ্যাতনামা মনীষী কামাল উদ্দিন ফারসির অবদান নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী কুতুবুদ্দিন মাহমুদ বিন মাসুদ বিন মোসলেহ কাজরোনির অবদান নিয়ে আলোচনা করবো যিনি কুতুবুদ্দীন শিরাজি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

কুতুবুদ্দীন শিরাজি ছিলেন হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকের ইরানি বিজ্ঞানীদের একজন। তিনি দর্শন, পদার্থবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও শিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইরান ও ইউনেস্কো ২০১১ সালে কুতুবুদ্দীন শিরাজির এক হাজার ২৫০ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছিল।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দেশ ইরানের দীর্ঘ ইতিহাসে এ দেশটি বিজ্ঞান, সভ্যতা ও মানব সমাজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ইরানের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা বাদ দিয়ে বলা যায় ব্যাপক, বিস্তৃত, প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী হচ্ছে এ দেশটি। নিঃসন্দেহে, এই বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সেই মনীষীদের কাছে ঋণী যারা এদেশের উন্নতির পথে জীবন ও অর্থ ব্যয় করেছেন। জ্ঞানবিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে বহু মনীষী ইরানের নামকে উজ্জ্বল করলেও দুঃখজনকভাবে আজকের দুনিয়ায় যখন বিজ্ঞানের  ইতিহাস নিয়ে কথা ওঠে তখন সবার নজর যায় পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ ও গবেষকদের দিকে।

খ্রিস্টিয় প্রায় ১৫শ' শতক থেকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ যুগের সূচনা হয়। এই রেনেসাঁর অন্যতম বড় অর্জন হল বিজ্ঞান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও বিস্তার গবেষণাকর্ম এবং মানব সমাজের বৈজ্ঞানিক সাফল্য। এর ফলে বিশ্বের মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কার ও গবেষণার জন্য ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচিত হলেও এসব বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি স্থাপনকারী ইরানসহ আরব ও এশিয়ার অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের বিষয়টি মানুষ ভুল যায়। এই মহান ইরানি বৈজ্ঞানিক নক্ষত্রদের মধ্যে একজন যিনি তাঁর তত্ত্ব ও আবিষ্কারের মাধ্যমে মানবজাতির বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি হলেন কুতুবুদ্দিন শিরাজি। তিনি কাতেবী কাযভীনির নিকট যুক্তিবিদ্যা এবং খাজা নাসিরুদ্দিন তুসীর নিকট দর্শন ও চিকিৎসাবিদ্যা পড়াশোনা করেন। তিনি ইবনে সিনার চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ 'কানুন' এবং সোহরাওয়ার্দীর দর্শন গ্রন্থ 'হিকমাতুল ইশরাক' ব্যাখ্যা করেন। তিনি দর্শনের প্রকারভেদ নিয়ে ফার্সিতে 'দুররাতুত তাজ' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর এ বই ও ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থগুলো বেশ মূল্যবান। তিনি ৭১০ অথবা ৭১৬ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন ।   

কুতুবুদ্দিন শিরাজি ছিলেন হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকের ইরানি বিজ্ঞানীদের একজন। তার পিতা ছিলেন তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা চিকিৎসক মৌলানা যিয়াউদ্দিন। মৌলানা যিয়াউদ্দিন সোফিয়ার শেখদের একজন ছিলেন এবং খ্রিস্টিয় ১২৩৬ সালে কাযরোনে তার জন্ম হয়। কুতুবুদ্দিন শিরাজি তার পিতা ও চাচার কাছে চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৪ তখন তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। এক পর্যায়ে অল্প বয়সেই তিনি তার বাবার পরিবর্তে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিরাজের বিখ্যাত হাসপাতাল মুজাফ্‌ফারিতে ডাক্তারি কাজ শুরু করেন।

চিকিৎসা ছাড়াও, কুতুবউদ্দিন অন্যান্য বিজ্ঞান যেমন গণিত, দর্শন, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, সঙ্গীত, বীণা বাজানো এবং কবিতা লেখা ও আবৃত্তি, দাবা খেলা এবং জাদু কৌশলের উপর আশ্চর্যজনক দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি ফারসি ও আরবি ভাষায় ২০টির বেশি পুস্তক রচনা করেছেন।

সোহরাওয়ার্দীর দর্শন গ্রন্থ 'হিকমাতুল ইশরাক'এর ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বইটিতে সমাজ, রাজনীতি ও সরকার সম্পর্কে কুতুবুদ্দিন শিরাজির সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। বিজ্ঞানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও কুতুবুদ্দিন শিরাজি তার সময়কালের নানা ঘটনা, পার্থিব জীবন ও রাজনৈতিক জীবন থেকে নিজেকে দূরে রাখেননি। তিনি সরকারি চাকরির পাশাপাশি সুলতানদের দরবারে যাতায়াতের মাধ্যমে অনেক বড় একটা সময় পার করেছেন। তিনি ইবনে সিনার চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ 'কানুন' ভালোভাবে রপ্ত করার পর মানমন্দির প্রতিষ্ঠায় ইবনে সিনাকে সহযোগিতা করেছিলেন। 'দুররাতুত তাজ' কুতুবুদ্দিন শিরাজির সবচেয়ে মূল্যবান গ্রন্থ যা "আন-মুযাজ আল-উলূম"সহ একটি দার্শনিক বিশ্বকোষ হিসাবে বিবেচিত।

কুতুবুদ্দিন শিরাজির লেখা বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে "নাহিয়ে আল-আদরাক ফি দারায়েহ আল-আফলাক" গ্রন্থটি আরবি ভাষায় রচিত হয়েছিল যা তিনি বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ আল জাভিয়ানিকে উৎসর্গ করেছিলেন।

এই গ্রন্থে চারটি ভাগে বিষয়বস্তুর বর্ণনা করা হয়েছে। এই চারটি বিষয় হচ্ছে ভূমিকা, বস্তুর গঠন প্রণালী, ভূ-পৃষ্ঠের কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য এবং উল্লেখিত বস্তুর পরিমাণ। এই বইটিতে তিনি মহাকাশ বিষয়ে ইবনে হিশাম এবং আবু বকর মুহাম্মদ বিন আহমদ খারকির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া কুতুবুদ্দিন শিরাজি বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে তার "নাহিয়ে আল-আদরাক ফি দারায়েহ আল-আফলাক" গ্রন্থে ভূতত্ত্ব, আবহাওয়াবিদ্যা, শক্তিবিদ্যা ও আলো সম্পর্কে মূল্যবান তত্ব ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। কুতুবুদ্দিন শিরাজি তার প্রবন্ধগুলোতে টলেমির লেখা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ 'আল্‌ম্যাজেস্ট' এর কিছু সমস্যার সমাধান তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া, তিনি বেশ কিছু বিষয়ে ইবনে সিনা ও ইমাম ফাখ্‌র রাযীর মতেরও সমালোচনা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক অনুসন্ধানমূলক বর্ণনা করেছেন। 'হিকমা আল-ইশরাক' গ্রন্থটি লিখেছেন শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী নামে একজন ইরানি দার্শনিক এবং ওই গ্রন্থের বিষদ ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন কুতুবুদ্দিন শিরাজি।

কুতুবুদ্দিন শিরাজি দার্শনিক বিষয় ছাড়াও গণিত ও চিকিৎসা শাস্ত্রেও পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন এবং এ সংক্রান্ত জ্ঞান ও দক্ষতা তার কাজ ও লেখনির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেণীভাগে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তিনি চাইতেন এ শ্রেণীভাগের মধ্যে দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মকেও অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তিনি বিজ্ঞানকে তাত্বিক ও প্রায়োগিক এ দুইভাবে বিভক্ত করেন। কুতুবুদ্দিন শিরাজি ধর্ম ও দর্শনকে জ্ঞানের দুটি ক্ষেত্র বা শাখা বলে মনে করতেন। তবে, এ দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি তার নিজস্ব নয়। তারই শিক্ষক খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি এবং এরও আগে ফাখর রাজির চিন্তাভাবনা থেকে তিনি এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে দুভানি, মীরদামাদ এবং মোল্লা সাদরার মতো দার্শনিকরাও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। এ কারণে কুতুবুদ্দিন শিরাজি দর্শন বিষয়ে তার 'দুররাতুত তাজ' গ্রন্থে কুরআনের আয়াত, হাদিস এবং ধর্মীয় বিধান উল্লেখ করে সমস্ত বিষয় একত্রিত করেছেন। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, ইউরোপে মধ্যযুগীয় যেসব দার্শনিকরা বলেছিলেন 'দর্শন হল ধর্মের সেবক' ইরানি চিন্তাবিদদের মধ্যে বহু বছর আগে তা বিদ্যমান ছিল।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ