একমাত্র ইসলাম ধর্মই দিয়েছে নারীকে সর্বোচ্চ ও ভারসাম্যপূর্ণ মর্যাদা
নারী: মানব-ফুল- ৬ (ইসলামে নারীর অধিকার)
গত কয়েক পর্বে আমরা প্রাচীন গ্রীস, রোম ও আরব উপদ্বীপ অঞ্চলে ইসলামপূর্ব যুগের নারী জাতির অমানবিক ও তাদের অধিকারের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা শুনেছি।
আজ আমরা ইসলাম ধর্মে নারীর মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করব।ইসলাম-পূর্ব যুগে গোটা বিশ্ব ছিল অজ্ঞতা ও কলুষতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছিল। নারী জাতি ছিল প্রায় মূল্যহীন পণ্যের মত এবং তারা ছিল কেবল পুরুষের জৈবিক ভোগ-বিলাসের সামগ্রী। তাদের মানবীয় সম্মান ও অধিকার বলতে কিছুই ছিল না।ইসলাম আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ায় সেখানকার নারীদের অমানবিক জীবন ও বন্দি দশার অবসান ঘটে। ইসলাম ধর্ম নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয় এবং নানা বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করে নারীকে দেয় মানবীয় ব্যক্তিত্বের সম্মান। একমাত্র ইসলাম ধর্মই দিয়েছে নারীকে সর্বোচ্চ ও ভারসাম্যপূর্ণ মর্যাদা। মহানবী (সা) কন্যা সন্তানকে সুগন্ধি ফুল বলে উল্লেখ করেছেন। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ)ও নারীকে সুগন্ধি ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
নারীর যে মমতাময়ী মাতৃহৃদয় ও সন্তান-বাৎসল্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং মানুষ গড়ার প্রতিভা তা যুগে যুগে বেশিরভাগ মানব সমাজেই যথাযথ মূল্য ও সম্মান অর্জন করেনি।ইসলাম-পূর্ব যুগের আরব সমাজে নারীর যদিও কোনো মূল্য ছিল না কিন্তু তা সত্ত্বেও আরবদের মধ্যে এমন কয়েকজন মানবও ছিলেন যারা কন্যাদেরকে জীবন্ত কবর দেয়ার প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এরকম একজন ব্যক্তিত্ব হলেন মহানবীর (সা) আহলে বাইতের প্রেমিক হিসেবে খ্যাত কবি ফারাজদাক-এর দাদা বনি তামিম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব «صعصعه بن ناجیه»، সা'-সা'-বিন নাজিয়া। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তিনি রাসুলের কাছে জানান যে তিনি তার দুটি হারানো উট খুঁজতে গিয়ে সেগুলোকে এমন এক ব্যক্তির কাছে পান, যে তার নবজাতক কন্যা সন্তান হওয়ার খবর শুনে তাকে জীবন্ত কবর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঘটনাক্রমে এটা শুনে সা'-সা'- ওই নবজাতক কন্যাকে সেই হারানো উট দু'টির বিনিময়ে কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেন এবং ওই ব্যক্তিও রাজি হয়।
এরপর থেকে সা'-সা'-বিন নাজিয়া এ ধরনের ঘটনা রোধে উট বিক্রি করে নবজাতক কন্যা সন্তানদের জীবন বাঁচাতেন এবং এভাবে তিনি বর্বরতার যুগে ২৮০ জন কন্যা শিশুর জীবন রক্ষা করেছিলেন। প্রত্যেক কন্যা সন্তানকে বাঁচাতে সা'-সা' সম্ভাব্য ঘাতক পিতাকে তিনটি করে উট দিতেন। মহানবী (সা) তাঁকে বলেছিলেন, এইসব শিশু কন্যার জীবন রক্ষার কারণে তোমার সামনে কল্যাণের দুয়ার খুলে গেছে এবং ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছ বলে আল্লাহ তোমাকে পুরস্কার দেবেন।
ইসলাম ধর্ম এই ভুল ধারণা নাকচ করে দেয় যে নারী নিকৃষ্ট সৃষ্টি ও কন্যা সন্তান হওয়া কলঙ্কের বিষয়। নারী হল সমাজের বোঝা এ ধারণাকেও অর্থহীন বলে বাতিল করে দেয় ইসলাম। ইসলাম-পূর্ব যুগে মানব-সমাজগুলোতে মানুষ যাকে খুশি তাকে বিয়ে করত ও যত বেশি সংখ্যক স্ত্রী রাখতে চাইত তাতে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু ইসলাম ধর্ম বোন, ফুফু বা পিতার স্ত্রী, পুত্রবধূ ও এ ধরনের সম্পর্কের নারীদের সঙ্গে বিয়ে করাকে নিষিদ্ধ করে দেয় এবং এভাবে নারীর সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম ধর্ম এটাও ঘোষণা করে যে কোনো কন্যাকে কোনো পুরুষ বিয়ে করতে চাইলে তাতে সেই কন্যার সম্মতি থাকা অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক। ইসলাম ধর্ম নারীকে বিয়ের ক্ষেত্রে মোহরানার প্রথা চালু করে। ইসলাম ধর্ম নারীর জন্য নাফাকা প্রথা চালু করে। ফলে কোনো নারী তালাক পাওয়ার পরও সন্তানের জন্য খরচ পাবেন সাবেক স্বামীর কাছ থেকে। এ ছাড়াও ইসলাম ধর্মের নীতি অনুযায়ী স্ত্রী সংসারের জন্য রোজগার বা আয় করতে বাধ্য নয়, কিন্তু পুরুষের জন্য তা বাধ্যতামূলক।

ইসলাম ধর্ম নারীকে স্বামী ও পিতা বা গোত্রের সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ার সুবিধা দান করে। পবিত্র কুরআনে নারী ও পুরুষের প্রতি সমান দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। সুরা নিসার ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: কোনো মানুষ তা সে পুরুষ হোক কিংবা নারী, যদি কোন সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণও নষ্ট হবে না।ইসলামের দৃষ্টিতে নারী তথা মা হচ্ছেন মানুষ গড়ার প্রশিক্ষক। তারা পরিবারে সন্তানদের নিয়ে ঠিক এ কাজই করেন। নারী হচ্ছে খোদায়ি দয়ার প্রতীক। মহানবী (সা) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে তারাই ভালো স্বামী যারা স্ত্রীদের প্রতি সর্বোত্তম। হযরত ইমাম সাদিক আ. বলেছেন, যে পুরুষ তারা স্ত্রীকে যত বেশি ভালবাসবে তার ঈমানও তত বাড়বে।
মহানবী (সা) নারীকে পাহলোয়ান না ভেবে তাদেরকে রেইহানা তথা সুগন্ধি ফুল বা পাতা ভাবতে বলেছেন। এর অর্থ নারী অত্যন্ত কোমল মন, দেহ ও স্নেহময় প্রকৃতির অধিকারী। তাই নারীর সঙ্গে সহিংস ও কঠোর আচরণ করা উচিত নয় এবং তাদের ওপর কোনো কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজ চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়।
ইসলাম ধর্ম নারীর বা স্ত্রীর অধিকার নষ্ট না করতে ও তালাক দেয়ার বিষয়ে পুরুষকে সতর্ক করে দিয়েছে। সুরা নিসার ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: নারীদের সাথে সদ্ভাবে তথা পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য উপায়ে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।নারী হচ্ছে মানব সমাজের অর্ধেক। তাই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী সন্তানদের তথা নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষক হওয়ায় ইসলাম ধর্মে তার রয়েছে বিশেষ সম্মান ও গুরুত্ব।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।