এপ্রিল ১৩, ২০২৩ ১৮:৫৬ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন বিখ্যাত মনীষী গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির জীবনী ও তার গবেষণাকর্মের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের অনুষ্ঠানেও আমরা জামশিদ কাশানির জীবনী নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখবো।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, উলুগ বেগ, কাজিজাদে রুমির মাধ্যমে জামশিদ কাশানি সম্পর্কে জানতে পারেন। কাজিযাদেহর সাথে বাজার এলাকায় গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির দেখা হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম। ঘটনাক্রমে কাজিযাদেহ একটি ছোট্ট ঘরে একজন খাটো আকৃতির মানুষকে বসে থাকতে দেখলেন। ওই ব্যক্তি একটি বইয়ে নজর বুলাচ্ছিলেন। তার আশপাশেও ছিল অনেক বই এবং অ্যাস্ট্রোল্যাবসহ জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত কিছু যন্ত্রপাতি। কাজিজাদেহ বুঝতে পারেন যে এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ। ফলে কাজিজাদেহ খুব খুশি মনে ওই ব্যক্তির ঘরটির দরজার খুব কাছে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করেন, এসব কী? ওই ব্যক্তি পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনি কী চান? কাজিজাদেহ বললেন, আমি এসব কিনতে চাই। ওই ব্যক্তি অর্থাৎ গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানি বললেন, কী কিনতে চান? কাজিজাদেহ বললেন, আমি অ্যাস্ট্রোল্যাবটি কিনতে চাই। জামশিদ কাশানি বললেন, এটা আপনার কি কাজে লাগবে? কাজিজাদেহ এক ধরনের বিশেষ অ্যাস্ট্রোল্যাবের নাম বললেন।

জবাবে গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানি বললেন, আমি এই অ্যাস্ট্রোল্যাবটি কেবল তার কাছেই বিক্রি করব যে গণিত বিষয়ে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর তথা কিছু সমস্যার সমাধান বলে দিতে পারবে। কাজিজাদেহ গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব দিতে পারেননি। এবার কাজিজাদেহ গণিত বিষয়ের পাল্টা কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেন জামশিদ কাশানির কাছে। কাশানি একে একে সবগুলো প্রশ্নের সঠিক জবাব দেন। এরপর কাজিজাদেহ প্রশ্ন করে জানতে পারেন যে এই বিজ্ঞ গণিতবিদের নাম গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানি। এ ঘটনার পর কাজিজাদেহ ও কাশানি পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু হন।

এরপর কাজিজাদেহ সমরকন্দে পৌঁছেন। সেখানে তিনি জানতে পারেন যে সম্রাট উলুগ বেগ একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং এ জন্য মহাকাশ ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত তথ্যের একটি নতুন সারণী তৈরির চেষ্টা করছেন। তিনি তখন সম্রাটের কাছে গিয়ে বলেন, ‘এ কাজের জন্য এক উপযুক্ত ব্যক্তি রয়েছেন। খাটো সাইজের ওই ব্যক্তি জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত প্রত্যেক ইঞ্চি দূরত্বের নানা দিক সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা রাখেন।’

উলুগ বেগ এই মহান বিজ্ঞানীর কথা শুনে এক ব্যক্তিকে তার কাছে পাঠান এবং তাকে কাশান থেকে সমরকন্দে আসার আমন্ত্রণ জানান। এরপর সম্রাট ওই মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব জামশিদ কাশানির ওপর ছেড়ে দেন। 

জামশিদ কাশানি তার ভাগ্নে মইনুদ্দিন কাশানিকে নিয়ে ৮১৯ থেকে ৮২২ হিজরিতে সমরকন্দে চলে আসেন। তিনি সমরকন্দ থেকে তার বাবার কাছে দু'টি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এ দুই চিঠিতে সমরকন্দের জ্ঞানী-গুণি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবস্থা ও শিক্ষা-কেন্দ্র সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। সেখানকার সম্রাট উলুগ বেগ ও বিজ্ঞানীদের পারস্পরিক সুসম্পর্কের কথা জানা যায় এ দুই পত্র থেকে। এ ছাড়াও এ দুই চিঠি থেকে সে সময়কার সমরকন্দের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যায়।

জামশিদ কাশানি যখন সমরকন্দে আসেন তখন তার বয়স ছিল প্রায় ত্রিশ বছর। উলুগ বেগের দরবারের অন্যান্য বিজ্ঞানীরা সমরকন্দে কাশানির জ্ঞানগত যোগ্যতার কঠিন পরীক্ষা নেন। তারা কঠিন যেসব বিষয়ের সমাধান জানতেন না সেসব বিষয়ে কাশানির কাছে সমাধান জানতে চান। তিনি সমরকন্দে তার সেই প্রথম দিনগুলোতেই এইসব জ্ঞানগত সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন। ফলে কাজিজাদেহ রুমির মত বড় বিজ্ঞানীও কাশানিকে নিজের চেয়েও বড় বিজ্ঞানী বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। এরপর থেকে জামশিদ কাশানি সব সময়ই সম্রাট উলুগ বেগের কাছে থাকতেন। উলুগ বেগও কাশানের এই অমূল্য রত্নের অসাধারণ প্রতিভার প্রশংসা করতেন। জামশিদ কাশানি সমরকন্দে দুই বছর থেকেছিলেন। এ দুই বছরে তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনেক সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাবার কাছে লেখা চিঠিতে তিনি এ বিষয়গুলোও তুলে ধরেন। যেমন, এসব বিষয়ের মধ্যে ছিল মসজিদের মেহরাবে বৃত্তাকার ছিদ্রের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো অতিক্রমের অবস্থা দেখে যে কোনো ঋতুতে আসরের নামাজের সময় নির্ধারণ করা, কিংবা প্রায় এক মিটার ব্যাসের অ্যাস্ট্রোল্যাব নির্মাণ যাতে নথিবদ্ধ ছিল টলেমির সারণিতে থাকা ১০২২ টি তারকার সারণী। 

সমরকন্দে আসার পর কিছু দিন না যেতেই জামশিদ কাশানি হয়ে পড়েন এখানে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানে নানা সাফল্য দেখিয়ে জামশিদ কাশানি সমরকন্দ বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেন।

সমরকন্দে মাত্র দুই বছর ছিলেন জামশিদ কাশানি। কিন্তু এ সময়ে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেসব অমূল্য অবদান রেখেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরতেও অনেক কাগজের পাতা দরকার হবে। যেমন, কাশানি সমরকন্দে থাকার সময় 'মিফতাহুল হিসাব' বা পাটিগণিতের চাবিকাঠি নামে প্রাথমিক পাটিগণিতের বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। তিনি তার এই বইয়ে প্রথমবারের মত দশমিক ভগ্নাংশের বিষয়টি তুলে ধরেন ও এর ব্যাখ্যা দেন। এ ছাড়াও এ বইয়ে তিনি পূর্ণ বা মৌলিক সংখ্যা বের করার উপায় তুলে ধরে এর ব্যাখ্যা দেন। তার এসব উদ্ভাবন ইউরোপে দশমিক ভগ্নাংশের প্রসারে বিস্ময়কর ভূমিকা রেখেছিল।

কাশানির এই বইটি ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাটিগণিতের গাইড-বই হিসেবে শত শত বছর ধরে পড়ানো হয়েছে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও কাশানির এইসব তত্ত্বের প্রয়োগ করা হত। 

গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানি সমরকন্দে থাকার সময় 'রিসালাত আল মুহিতিইয়্যাহ' বা 'বৃত্তের পরিধি সম্পর্কিত গবেষণা-পত্র' নামের একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ে তিনি গণিতের বিশিষ্ট সংখ্যা তথা বৃত্তের কোণের পরিমাপে ব্যবহৃত 'পাইয়ের' মান ১৬ দশমাংশ পর্যন্ত নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি 'বৃত্তের জ্যা এবং সাইন সম্পর্কিত গবেষণা-পত্র' শীর্ষক তার বইয়ে সাইনের এক ডিগ্রির পরিমাপকে সঠিক মানের কাছাকাছি দশ সংখ্যা পর্যন্ত নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গণিতের তত্ত্বীয় গবেষণা ছাড়াও বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও তিনি ব্যাপক উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। জামশিদ কাশানি জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত ৮টি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ