পবিত্র কুরআনের মুফাসসিররা বিশ্বাস করেন নারী ও পুরুষের উচিত সমপর্যায়ের কাউকে বিয়ে করা
সুখের নীড়-৩৫ (তালাকের নানা কারণ ও প্রতিকার)
দাম্পত্য জীবন ও পরিবারের মূল ভিত্তি হলেন স্বামী ও স্ত্রী। তাদের মধ্যে যত বেশি সমন্বয়, সমানুভূতি ও ব্যক্তিত্বের সংহতি থাকবে ততই তাদের বন্ধন হবে মজবুত, ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক।
পবিত্র কুরআনে সুরা নূরের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: দুশ্চরিত্রা নারীকুল দুশ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্যে এবং দুশ্চরিত্র পুরুষকুল দুশ্চরিত্রা নারীকুলের জন্যে। সচ্চরিত্রা নারীকুল সচ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্যে এবং সচ্চরিত্র পুরুষকুল সচ্চরিত্রা নারীকুলের জন্যে। তাদের সম্পর্কে লোকে যা বলে, তার সাথে তারা সম্পর্কহীন। তাদের জন্যে আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।
পবিত্র কুরআনের মুফাসসিররা বিশ্বাস করেন নারী ও পুরুষের উচিত সমপর্যায়ের কাউকে বিয়ে করা। মনস্তত্ত্ববিদরাও আজকাল এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। অন্য কথায় স্বামী ও স্ত্রীকে নানা দিক থেকে সমধর্মী এবং একই নীতি-নৈতিকতায় বিশ্বাসী হতে হবে। পারিবারিক ঐতিহ্য, বয়স, শিক্ষা, চিন্তা, বিশ্বাস, স্বভাব ও আচার-আচরণের দিক থেকে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মিল থাকা উচিত। গত পর্বের আলোচনায় আমরা পরিবারের ভেতরে সহিংসতা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা তালাক ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে কথা বলব।
বর্তমান বিশ্বে সব দেশেই তালাকের হার ক্রমেই বাড়ছে। অতীতে স্ত্রীরা নানা সংকট ও নির্যাতনের শিকার হলেও সহজেই তালাক নিতেন না সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অথবা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর না হওয়ার কারণে। কিন্তু বর্তমান যুগে স্ত্রীরা উচ্চ-শিক্ষিত হওয়ায় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর হওয়ায় তালাক নিতে ভয় পান না। এমনকি কখনও খুব সামান্য মনোমালিন্য বা বিবাদের জেরে তালাক নিচ্ছেন। আর স্ত্রী যদি মনে করেন যে স্বামী প্রায়ই তাকে অপমান করছেন ও তার সঙ্গে সহিংস আচরণ করেছেন এ অবস্থায় সংসার টিকিয়ে রাখা উচিত বলে তিনি মনে করছেন না। যদিও মনে করা হত যে আধুনিক যুগে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার কারণে সচেতনতা বেড়েছে ফলে পরিবারে নারীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য কমে আসছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এখনও নারীর ওপর সহিংসতার মাত্রা তেমন একটা কমে যায়নি। ফলে দুর্ব্যবহার ও সহিংসতা থেকে বাঁচতে তালাক নিচ্ছেন স্ত্রীরা। স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়া বা সমঝোতার অভাব এবং পরস্পরকে না জানা ও বুঝতে না পারার বিষয়টিও তালাকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
অনেক সময় দেখা যায় স্বামী স্ত্রীকে কোনো বিশেষ ধরনের চাকরি করতে দিতে চান না বলে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা তালাক অপরিহার্য হয়ে উঠছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী ও স্ত্রীর বিচ্ছিন্নতা বা তালাক সমস্যার সমাধান এনে দেয় না বরং জীবনকে আরও দুর্বিসহ করে তোলে প্রায় ক্ষেত্রেই। দেখা যায় যে নতুন পরিবেশে নতুন স্বামী বা নতুন স্ত্রীর সঙ্গে এবং তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো না হয়ে বরং আগের চেয়েও খারাপ হচ্ছে। তালাকের পর অনেকই নতুন করে বিয়ে করার সুযোগ পান না, ফলে তারা শারীরিক ও মানসিক নানা সংকটের শিকার হচ্ছেন। তবে কখনও কখনও তালাক নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হয়ে পড়ে। তাই বিয়ের চুক্তিপত্রে তালাকের ব্যবস্থাও থাকা উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। ইসলাম ধর্মও এ কারণেই তালাকের পথ খোলা রেখেছে। একজন নারী ও পুরুষকে তাদের মানসিক ইচ্ছার বিপরীতে জোর করে যেমন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা ঠিক নয় তেমনি তালাক অপরিহার্য হয়ে উঠলে তা ঠেকিয়ে রাখাও কল্যাণকর নয়। তবে সমাধানের অযোগ্য চরম সংকটের মত অপরিহার্য পরিস্থিতি দেখা না দিলে তালাকের চিন্তাও করা উচিত নয়।
বিয়ে হচ্ছে এক সুদৃঢ় অঙ্গীকার-ভিত্তিক বন্ধন। পবিত্র কুরআনের সুরা রুমের ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।
এই আয়াতের আলোকে এটা স্পষ্ট যে তালাক অপছন্দনীয় কাজ এবং কখনও কখনও তা মহাপাপ। হাদিসে বলা হয়েছে মহান আল্লাহর কাছে সেই ঘরই সবচেয়ে প্রিয় যে ঘরের মানুষ বিবাহিত। অন্যদিকে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ঘর হল সেই ঘর যে ঘরের মানুষ তালাকের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনকে করেছে বিচ্ছিন্ন। মহানবী (সা) বলেছেন, তোমরা বিয়ে কর, কিন্তু তালাক দিও না, কারণ তালাকের ঘটনায় আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।
প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ইবনে সিনার মতে স্ত্রী হচ্ছেন স্বামীর অর্থনৈতিক শরিক, সংসার চালনায় সহযোগী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি এবং পুরুষের জন্য প্রশান্তিদাতা। পুরুষ তার স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা একমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই বৈধভাবে মেটাতে সক্ষম। তাঁর মতে আদর্শ সভ্য রাষ্ট্রে অবশ্যই বিয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং মানুষকে বিয়ে করতে উৎসাহ দিতে হবে যাতে মানব প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। বিয়ে হওয়া উচিত প্রকাশ্যে যাতে পারিবারিক সম্পর্কগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আর সফল পরিবার গঠনের জন্য শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ জরুরি এবং যে বয়সেই তা বিকশিত হয় তখনই বিয়ে করা উচিত।
ইবনে সিনার মতে স্বামীর উচিত পরিবারের প্রধান পরিচালক হিসেবে নানা ঘাটতি পূরণ করা ও দুর্বলতাগুলো ঢেকে রাখা যাতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সঠিক ভিত্তির ওপর মজবুতভাবে গড়ে ওঠে। স্বামীর উচিত স্ত্রীর কাছে নিজের সম্মান বজায় রাখা এবং ধর্ম ও সুনীতির অনুসারী হওয়া; কখনও কোনো ওয়াদা দিলে তা পূরণ করা। ইবনে সিনার মতে স্বামীর উচিত স্ত্রীকে সম্মান করা ও স্ত্রীরও উচিত স্বামীকে সুশীল ব্যক্তি হিসেবে দেখার পর তাকে সম্মান করা। সম্মান দেয়া ছাড়া স্ত্রীকে জোর করে বশে আনা যায় না। ইবনে সিনা আরও মনে করতেন স্ত্রীকে সংসারের জন্য ভালো ও কল্যাণকর নানা কাজে মশগুল রাখতে হবে। তাকে সন্তান প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণে উৎসাহ দিতে হবে। নানা ধরনের ভালো কাজে স্ত্রীকে ব্যস্ত রাখতে পারলে তারা কখনও পরপুরুষকে আকৃষ্ট করতে সাজ-সজ্জার মুখাপেক্ষী হবে না এবং এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মানও অটুট থাকবে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।