মে ০৭, ২০২৩ ১৩:২৫ Asia/Dhaka

জ্যোতির্বিদ্যা প্রাচীনতম মৌলিক বিজ্ঞানগুলির মধ্যে একটি এবং এটি মানুষের বুদ্ধিমত্তা, কৌতূহল ও প্রতিভা প্রকাশে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। কিভাবে মহাজাগতিক বস্তু গঠিত হয়, একে অপরের ওপর বস্তুগুলোর প্রভাব এবং কি ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে প্রভৃতি সবসময়ই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই বিশ্বের ভূমি এমন এক পরীক্ষাগার যেখান থেকে প্রতিনিয়ত মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়।

মানব সভ্যতার বিকাশের শুরু থেকেই সব জাতির মধ্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রাচীন মানব সভ্যতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পারস্য সভ্যতা। পারস্যে তথা আজকের ইরানে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস অনেক পুরানো। ইরানের ফার্স প্রদেশে তাখতে জামশিদের কাছেই রয়েছে বিখ্যাত নাকশে রুস্তাম। প্রত্নতাত্বিক এই অঞ্চলে হাখামানেশিয় যুগের বিভিন্ন শিলালিপির মধ্যে সৌর মানমন্দিরের নকশা দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়ের গায়ে খোদাইকৃত বিশাল নাকশে রুস্তাম চিত্রকর্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর আগের।

ইসলামপূর্ব যুগে প্রাচীন পারস্য বা ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণা কর্মকে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহাকাশ গবেষণার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে সাসানিয় যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা কর্মের কথা উল্লেখ করা যায় যে সম্পর্কে মুসলিম মনীষীরা উল্লেখ করে গেছেন। উদাহরণ স্বরূপ আবু রেইহান বিরুনি তার পান্ডুলিপিতে প্রাচীন পারস্যের খসরু আনু শিরওয়ানির যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কথা উল্লেখ করেছেন। ওই যুগের জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণাকর্ম ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয় যা কিনা মুসলিম মনীষীদের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া তারা সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কেও ধারণা দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দারিয়ুসের যুগে একটি শিলালিপিতে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাওয়ার স্থান উল্লেখ করা হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ থেকে ৫২৯ বছর আগে মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত মানমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল এবং সে সময় চাঁদ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ও মঙ্গল গ্রহের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হতো। 

হাকাশের বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ ও চন্দ্র, সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের জন্য  মানমন্দির ছিল প্রধান গবেষণা কেন্দ্র এবং ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই ইরানে মানমন্দিদের অস্তিত্ব ছিল। ইসলাম পরবর্তী যুগে ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রথম মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এরপর মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও এ ধরণের কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রের সাথে বিখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নাম জড়িয়ে আছে। অবশ্য হিজরি চতুর্থ শতাব্দির পর মানমন্দিরগুলোর সাথে আমির-ওমরা ও রাজা-বাদশাহদের নাম যুক্ত থাকতে দেখা যায় এবং তাদের সাহায্য সহযোগিতায় জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা বহুগুণে সমৃদ্ধ ও উন্নতি লাভ করেছিল। ইরানে হিজরি দ্বিতীয় থেকে দশম শতাব্দি তথা খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে ১৬শ' শতাব্দি পর্যন্ত সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বই এবং ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করার পাশাপাশি তাদের গবেষণালব্ধ তত্ত্বগুলো সম্পূর্ণ করার জন্য ততকালীন শাসকদের সহায়তায় মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

আবু রেইহান বিরুনি, আব্দুর রহমান  খাযানি, গিয়াস উদ্দিন কাশানি প্রমুখ ইরানি মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চাঁদের গতিবিধি পরিমাপ করার জন্য পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং তারা নিয়মিত চাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। তারা তাদের রেখে যাওয়া গ্রন্থগুলোতে নির্ভুল পর্যবেক্ষণের পদ্ধতিগুলোর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন। ওই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণাকর্ম ইরানি ক্যালেন্ডার নির্মাণের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল। এ কারণে তারা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সঠিক ক্যালেন্ডার লেখক বলে বিবেচিত হতেন। ইরানের এই মানমন্দিরগুলোর আরেকটি আকর্ষণীয় দিক ছিল পৃথিবীর পরিবেশ ও আয়তন পরিমাপ করা যা কিনা সূর্যাস্তের সময় সূর্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে করা হয়েছিল। ইসলাম পরবর্তী যুগে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র তথা মানমন্দিরের কার্যক্রমের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ১৩শ' খ্রিষ্টাব্দ। কারণ এই শতাব্দিতে 'মারাগেহ মানমন্দির' নির্মিত হয়েছিল যা কিনা ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানমন্দির হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। সে সময় বিখ্যাত ইরানি মনীষী খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি হালাকু খানকে এটি নির্মাণে উৎসাহিত করেছিলেন। ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

ইরানের উত্তর-পশ্চিমে মারাগেহ শহরে নির্মিত হয়েছিল এই 'মারাগেহ মানমন্দির'। এর পাশেই গড়ে তোলা হয়েছিল খুবই সমৃদ্ধ ও বৃহৎ একটি গ্রন্থাগার। ওই গ্রন্থাগারে প্রায় চার লক্ষ বই সংরক্ষিত ছিল। 'মারাগেহ মানমন্দির' শুধুমাত্র গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য ছিল না বরং এটি ছিল একটি সুবিশাল বৈজ্ঞানিক গবেষণার। এখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার শিক্ষা দেয়া হতো। ওই সময়কার অন্যতম বিখ্যাত গবেষক ও মনীষী ছিলে কুতুবুদ্দিন শিরাজি যিনি রংধনু গঠনের প্রধান কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। এ ছাড়া যেহেতু ওই সময় চীন ও ইরানের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল সে কারণে ফাও মুন জি এর মতো অনেক চীনা গবেষক মারাগেহ মানমন্দিরে গবেষণা কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া একজন খ্রিষ্টান দার্শনিক ও অভিধান লেখক ইবনে আল ইবরিও মারাগে মানমন্দিরে ছাত্রদেরকে ইউক্লিড এবং টলেমির নীতি শেখাতেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই মানমন্দিরের ভবনের উপরে ছাদে একটি বিশালাকৃতির গম্বুজ ছিল। দিনে সূর্যের আলো ওই গম্বুজে প্রবেশ করতো এবং সূর্যের একটি চেহারা সেখানে দৃশ্যমান হতো। ওই চেহারা দেখে ঘন্টা, দিন, ঋতু ও বছরে সূর্যের অবস্থান ও গতিবিধি নির্ণয় করা হতো।

সেই যুগের বিভিন্ন লেখনিতে জানা যায় মারাগা মানমন্দির নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যত জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ঘটনা সম্পর্কে আগাম ধারনা লাভ করা। এ ছাড়া আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কারো কারো অতিরঞ্জিত ও অমূলক ধারণা রোধ করা। ফলে জ্যোতিশাস্ত্রের নামে মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার প্রচলিত ছিল তা অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল। ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন জিজে বা সারণী অর্থাৎ ছক তৈরি করতেন যার মাধ্যমে নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি চিহ্নিত করা যেত। জিজ বলতে জ্যোতির্বিদরা গ্রহ-নক্ষত্রসহ আকাশের নানা বস্তুর অবস্থা আর গতিবিধির বর্ণনাকে বোঝায় যা তারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করেন। ওই যুগের একটি নামকরা জিজে বা ছকের নাম হচ্ছে 'জিজে আল হাকিম' এবং মুসলমানরা বহু বছর ধরে তাদের গবেষণা কাজে এইসব ছক ব্যবহার করতেন। এরপর মুসলমানরা মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত বহু যন্ত্রপাতি তৈরি করেন। এদের মধ্যে অন্যতম খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন খাজা নাসির উদ্দিন তুসি ও আবু রেইহান বিরুনি।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ