দুই নবীর অসৎ স্ত্রী ও জালিম ফেরাউনের মুমিন স্ত্রী!
সুখের নীড়-৩৭ ( বিবি আসিয়া ও কুরআনে উল্লেখিত চার ধরণের নারী)
সুখের নীড় শীর্ষক বিগত অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা পরিবার নামক পবিত্র ব্যবস্থার নানা গুরুত্ব এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে কথা বলেছি।
পরিবার ব্যবস্থার সুরক্ষার ও এর জন্য ক্ষতিকর বা ধ্বংসাত্মক নানা চালিকাশক্তি সম্পর্কেও আলোকপাত করেছি। আসমানি দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ ও আদর্শ ধর্ম হিসেবে পরিবার ব্যবস্থার আদর্শ হিসেবে আদর্শ মহামানব ও মহামানবীদের দাম্পত্য জীবনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। মানুষ যত বেশি তাদের অনুসারী হবে ততই তাদের সংসার ও পারিবারিক জীবন উন্নত এবং সুখময় হবে।
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে উন্নত পরিবার গঠনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য দরকার মহতী নানা গুণ ও নৈতিকতার অধিকারী হওয়া। ফলে এ ধরনের পরিবারের সন্তানরা হবে আদর্শ ও ন্যায়নিষ্ঠ ইসলামী সমাজ গঠনের যোগ্যতার অধিকারী।
পবিত্র কুরআনে চার ধরনের পরিবারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে: প্রথমত একই ধরনের মহত চিন্তা ও স্বভাবের অধিকারী স্বামী ও স্ত্রী। তারা উভয়ই সৎকর্মশীল এবং সৎ কাজে পরস্পরের সহযোগী। যেমন, মহানবী (সা) ও হযরত খাদিজা-সা, কিংবা হযরত আলী ও ফাতিমা-সা.আ। দ্বিতীয়ত স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই মন্দ চিন্তাধারা ও স্বভাবের অধিকারী। এরা মন্দ কাজে একে অপরের সহযোগী। যেমন, আবু লাহাব ও তার স্ত্রী। তৃতীয়ত এমন পরিবার যে পরিবারে স্বামী ভালো হলেও স্ত্রীরা মন্দ প্রকৃতির। যেমন, হযরত লুত ও নুহ নবীর স্ত্রীরা। চতুর্থত: এমন পরিবার যে পরিবারের স্ত্রীরা ভালো কিন্তু স্বামীরা মন্দ ও নিকৃষ্ট স্বভাবের অধিকারী বা জালিম ও খোদাদ্রোহী প্রকৃতির। যেমন, ফিরাউন ও তার স্ত্রী বিবি আসিয়া।
বিবি আসিয়া ছিলেন উন্নত আধ্যাত্মিক ও খোদায়ি প্রকৃতির অধিকারী। কিন্তু তার স্বামী ফিরাউন খোদায়ি প্রকৃতির বিরোধী ছিল। সে তার মানবীয় মূল্যবোধ ও প্রকৃতিকে নিজের কুপ্রবৃত্তির কাছে বিসর্জন দিয়েছিল। খোদাদ্রোহী ও জালিম ফিরাউন ছিল মিশরের শাসক। দুর্দান্ত প্রতাপ ও জাঁকজমকের অধিকারী ফিরাউন বিবি আসিয়ার রূপের খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করেছিল। মহিয়সী নারী আসিয়া ছিলেন জনদরদি। তাই ফিরাউনের প্রাসাদে এসে তিনি বঞ্চিত জনগণের কল্যাণে কাজ করার ও জনগণকে সহায়তা দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিবি আসিয়া খোদাদ্রোহী ও জালিম স্বামীর নিত্য-নৈমিত্তিক এবং নতুন নতুন জুলুম-এসবের কিছুই পছন্দ করতেন না। কিন্তু স্বামীকে সংশোধন করতে পারবেন এই আশায় ধৈর্য ধারণ করেছিলেন। মাঝে মধ্যেই তিনি স্বামীকে যথাযথ উপদেশ দিয়ে ও সতর্কবাণী শুনিয়ে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাতেন। বিবি আসিয়া স্বামীর চাকচিক্যময় জীবন ও অঢেল বস্তুগত উপকরণের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। এমন প্রতিকুল ও কঠিন পরিবেশেও তিনি মহান আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তথা ঈমানে ও আনুগত্যে অবিচল ছিলেন এবং পাপ এড়িয়ে চলতেন।
হযরত মুসা নবী যখন একত্ববাদী ধর্ম প্রচার শুরু করেন তখন বিবি আসিয়া ছিলেন তাঁর এই দাওয়াতের প্রতি প্রথম দিকেই সাড়া দানকারীদের অন্যতম। ফিরাউন তার স্ত্রীকে এ ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করার জন্য প্রথমে নানা প্রলোভন দেখান। এরপর ফিরাউন তাকে নানা ধরনের ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় তাকে উন্মাদিনী বা পাগলী বলে অভিযুক্ত করে। জবাবে হযরত আসিয়া বলেছিলেন, আমি উন্মাদিনী নই। আমার ও তোমার স্রষ্টা তথা খোদা হলেন তিনি যিনি আকাশ, জমিন, পর্বতমালা ও সাগর সৃষ্টি করেছেন। আসিয়া মহান আল্লাহর প্রতি নিজের হৃদয়কে সমর্পণ করেছিলেন এবং এর সুবাদে তিনি আধ্যাত্মিকতা ও উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। প্রকৃত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা মানুষের জীবনকে করে অর্থপূর্ণ। বর্তমান আধুনিক যুগেও ধার্মিকতা ও আধ্যাত্মিক আলোর অধিকারী ব্যক্তিরা অধার্মিক ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি সুস্থ এবং আচরণেও তারা সঠিক প্রকৃতির অধিকারী। তারা পরিপক্বতা ও আধ্যাত্মিক পরিচিতির অধিকারী। আধ্যাত্মিকতা মানুষকে দেয় আন্তরিকতা, আত্মত্যাগ, সাধনার শক্তি, প্রবৃত্তিকে দমনের যোগ্যতা, সৎকর্মশীলতা, কল্যাণকামী মন ও জীবনকে ঘিরে ইতিবাচক চিন্তার প্রাচুর্য।
ফিরাউনের দুর্নীতিগ্রস্ত মন ও আধিপত্যকামি চিন্তা এতটাই জোরদার হয়েছিল যে সে তার স্ত্রীকেও চরম নির্যাতনের শিকার করেছিল। জালিম স্বামীর নির্দেশে বিবি আসিয়াকে চারটি বড় পেরেকে বা লোহার খুঁটিতে বিদ্ধ করা হয় এবং এ অবস্থায় তাকে বলা হয় যে আল্লাহর প্রতি ঈমান ত্যাগ করলে তাকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনা হবে ও তিনিই ফিরাউনের রানীর পদে বহাল থাকবেন। কিন্তু আসিয়ার হৃদয়ে খোদাপ্রেমের যে অনির্বাণ শিখা জ্বলে উঠেছিল তার কাছে ফিরাউনের জুলুম ও কুফুরিতে পরিপূর্ণ প্রাসাদের বাহ্যিক চাকচিক্য ও বিলাস ছিল আকর্ষণ-বিহীন বরং ঘৃণ্য পার্থিব উপকরণ। আসিয়ার মন তখন আকুল হয়ে উঠেছিল ঈমানের প্রশান্ত উপকূলে উপনীত হতে এবং চিরপ্রশান্তির কোলে ঠাঁই নিতে। তাই জীবনের শেষ নিঃশ্বাসগুলো ফেলার আগে দয়াময় আল্লাহর কাছে তিনি প্রার্থনা করলেন, ফিরাউনের প্রাসাদের পরিবর্তে তাঁর জন্য যেন খোদায়ি রহমতের ছায়াতলে বেহেশতে একটি কুটির নির্মাণ করা হয় এবং তিনি ফিরাউন ও তার দলবলের ঘৃণ্য তৎপরতা হতে আবারও সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিয়ে
ঈমানকে পরিপূর্ণ করেন।
পবিত্র কুরআনের সুরা তাহরিমের ১১ নম্বর আয়াতে বিবি আসিয়ার সেই প্রার্থনার বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে আদর্শ মুমিন ও সংগ্রামীদের আদর্শ হিসেবে: আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।
এভাবে মহিয়সী নারী আসিয়া দেখিয়েছেন যে মুমিন নারী ও জালিম কাফির একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না। আসিয়া মাতৃস্নেহ ও যত্ন দিয়ে শিশু মুসা নবীকে উদ্ধার করে তাঁকে বড় করেছিলেন। মুসা নবীকে তিনি নয়নের আলো বলে উল্লেখ করেছিলেন। অবশেষে যে দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা তার ছিল তার আলোতে তিনি মুসা নবীর নবুওতের প্রতি ঈমান আনেন ও একত্ববাদের প্রচারক হয়ে যান।
অন্যদিকে নুহ ও লুৎ নবীর স্ত্রীরা নিজ নিজ স্বামীর আধ্যাত্মিকতা ও মহতী মানবগুণের আলোকোজ্জ্বল আদর্শের ছায়াতলে থেকেও সেসবের প্রতি বিমুখ হয়ে কুফ্র্ ও শির্কে অবিচল থেকেছে। তারা সমাজের কাফের-মুশরিকদের সহযোগী হয়ে নবী-রাসুলের প্রদর্শিত পথের বিপরীতে বিভ্রান্তির অতলেই অবস্থান নেয়। সুরা তাহরিমের দশ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
আল্লাহ তা’আলা কাফেরদের জন্যে নুহ-পত্নী ও লুত-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। তারা ছিল আমার দুই ধর্মপরায়ণ বান্দার তথা নবীর গৃহে। অতঃপর তারা ওই দুই নবীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। ফলে নুহ ও লুত তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার শাস্তির কবল থেকে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হলঃ জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও।
মুমিন বান্দাদের উচিত অন্য এক একত্ববাদী ও বিশ্বস্ত মুমিন বান্দাকেই বিয়ে করা। লুত ও নুহ নবীর ওই দুই দুর্ভাগা স্ত্রী সহধর্মিনী হতে পারেননি। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে কাফেরদের কাছে নবীর গোপনীয় তথ্যগুলো ফাঁস করত। নুহ নবীর ওই স্ত্রী জনগণকে বলতো যে নুহ হচ্ছেন পাগল। কেউ নুহ নবীর প্রতি ঈমান আনলে ওই স্ত্রী মুশরিক গোত্র প্রধানদের কাছে সেই সংবাদ পৌঁছে দিত। ফলে ওই মুমিনের ওপর নেমে আসতো মুশরিকদের নৃশংস অত্যাচারের খড়গ। এভাবে নুহ নবী (আ) যে কেবল ঘরের বাইরেই মুশরিক গোত্রপতি ও দাম্ভিক অজ্ঞ লোকদের মুখোমুখি হতেন তা নয় ঘরের ভেতরেও তাঁকে সতর্ক থাকতে হত। এই স্ত্রীর প্রভাবে নুহ নবীর এক পুত্র সন্তানও অবিশ্বাসী বা কাফির হিসেবেই মারা যায়।
লুত নবীর স্ত্রীও ছিলেন কাফির ও মুশরিকদের চিন্তাধারার মাধ্যমে বিভ্রান্ত। সে ব্যভিচারী না হলেও লুত নবীর অনুগত ছিল না। তার মধ্যেও ছিল নীচতা, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রকৃতি। লুত ও নুহ নবীর স্ত্রীর ঘটনা থেকে বোঝা যায় কেবল নবীর স্ত্রী হলেই তা মুক্তি অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং দরকার ইমান ও খোদাভীতি। স্ত্রীরা যদি স্বামীদের ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শের বিপরীত পথে বা কপটতার পথে চলেন তাহলে সংসার পরিণত হবে জাহান্নামে। তাই বিয়ে করার আগে স্বামী বা স্ত্রীর ধর্মমতের বিষয় যাচাই করে নেয়া উচিত।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৭