মে ০৭, ২০২৩ ১৯:২০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআন পবিত্র ও আদর্শ নারীদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। এ প্রসঙ্গে আমরা গত পর্বের আলোচনায় হযরত মুসা নবীর মা ও ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আসিয়ার  জীবনের শিক্ষণীয় ঘটনা সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। আজ আমরা হযরত আদম (আ)'র স্ত্রী হযরত হাওয়া সম্পর্কে কথা বলব।  

হযরত হাওয়া হচ্ছেন মানব-ইতিহাসের প্রথম নারী। তিনি গোটা মানবজাতির আদি মাতা। হওয়া শব্দের অর্থ জীবনের উৎস তথা মাতা। পবিত্র কুরআনে হাওয়া নাম উল্লেখ করা হয়নি তবে হযরত আদমের স্ত্রীর ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোতে, ঐতিহাসিক বর্ণনায় এবং ইসলামী বর্ণনায় হাওয়া নাম এসেছে। তিনি ও হযরত আদম নিষিদ্ধ ফল খেয়েছেন। এরপর পৃথিবীতে তাদেরকে পাঠানো হয়েছে। তবে ওই ফল না খেলেও তাঁদেরকে পৃথিবীতে আসতেই হত। কারণ মহান আল্লাহ ধরণীতে আল্লাহর প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চান এমন ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। 

 পবিত্র কুরআনের সুরা আরাফের ১৮৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নারী ও পুরুষের উৎসকে একই বলে উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন: তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে; আর একই উৎস বা জিনিস থেকেই তৈরি করেছেন তার জোড়া বা স্ত্রী, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে। 

তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে

 

সুরা নিসার এক নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি একই উৎস বা জিনিস থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।– এসব আয়াত থেকে স্পষ্ট যে হাওয়াকে হযরত আদমের শরীর থেকে সৃষ্টি করা হয়নি বরং উভয়কেই একই বস্তু বা উৎস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। হাওয়াকে আদমের জন্য নির্ধারিত মাটি বা কাদার বর্ধিত অংশ থেকে বানানো হয়েছে বলে মনে করাও ঠিক হবে না। অন্য কথায় নারী ও পুরুষ একই মানবীয় সত্ত্বার অধিকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের কারণে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। 

সব মানুষই যদি একথা মনে রাখে যে তারা হযরত আদম ও হাওয়ার বংশধর তাহলে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা জাগবে না। আর এ জন্যই সুরা নিসার প্রথমেই সব মানুষকে বলা হয়েছে তারা যেন আল্লাহকে ভয় করেন।– 

বলা হয় হযরত আদম যখন বিবি হাওয়াকে প্রথমবারের মত দেখেন তখন আল্লাহকে প্রশ্ন করেন যে কে ইনি যার নৈকট্য ও দৃষ্টি আমার  মধ্যে তার প্রতি মায়াবী আকর্ষণ বা অনুরাগ সৃষ্টি করেছে? আল্লাহ বললেন, সে হচ্ছে হাওয়া। তুমি কি পছন্দ কর যে সে তোমার সঙ্গে থাকুক এবং তোমার ভালোবাসা বা অনুরাগে সিক্ত হোক আর তোমার সাথে কথা বলুক; তোমার অনুগত হোক? আদম বললেন, হ্যাঁ! আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা আমার কর্তব্য। এরপর আল্লাহ বললেন, তুমি তাকে বিয়ে করার বিষয়ে আমার কাছে আবেদন জানাও, কারণ সে তোমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য....। এরপর হযরত আদম (আ) বলেন, আমি তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পেশ করছি, কিসে আপনার সন্তুষ্টি? মহান আল্লাহ বললেন, তুমি তাঁকে আমার ধর্ম শেখাবে –এটাতেই রয়েছে আমার সন্তুষ্টি! 

এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় বিয়ের ভিত্তি হচ্ছে ভালো লাগা বা পছন্দ করা এবং ঘনিষ্ঠতা।  এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি কি জানতে চেয়েছেন হযরত আদম। এর অর্থ যে শর্ত পূরণ করে তথা যে মোহরানা বা পুরস্কার দিয়ে বিবি হাওয়াকে বিয়ে করতে হবে তা হল হাওয়াকে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। হযরত আদম (আ) ওই শর্ত মেনে নেন। 

আদম ও হাওয়ার বিয়ের পর যা ঘটেছিল তা হল, আদম হাওয়াকে বললেন, আমার কাছে আস ও আমার দিকে তাকাও! জবাবে হাওয়া বললেন, আপনি আমার দিকে আসুন ও আমার দিকে তাকান! আল্লাহ তখন আদমকে তার স্থান থেকে হাওয়ার দিকে যেতে বললেন। আর এখান থেকেই শুরু হয় নারীর কাছে পুরুষদের বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার প্রচলন।  সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক সমাজেই নারীরা পুরুষকে নয় বরং পুরুষরাই নারীদেরকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এর মাধ্যমে নারীকে খাটো করা হয়নি বা তাকে পণ্য বলে বিবেচনা করা হয়নি! আসলে এর মাধ্যমে নারীর প্রতি বড় ধরনের সম্মান দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পুরুষের প্রবৃত্তিকে এমন করেছেন যে সে নারীর ব্যাপারে হবে প্রার্থী এবং অন্যদিকে নারীর প্রবৃত্তিকে এমন করা হয়েছে যে তারা সহজেই অনুরাগীর কাছে ধরা দিতে চায় না বরং তার আগে অনুরাগীর কাছ থেকে প্রশংসিত হতে চায় ও আবেদন নিবেদন দেখতে চায়।  

বিয়ের ভিত্তি হচ্ছে ভালো লাগা বা পছন্দ করা এবং ঘনিষ্ঠতা

 

পবিত্র কুরআনে বিবি হাওয়ার সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বক্তব্য নেই। পবিত্র কুরআনের বক্তব্যে দেখা যায় হযরত আদম ও হাওয়াকে বেহেশতে থাকতে দেয়া হয়। তাঁদেরকে বলা হয় যে তাঁরা  বেহেশতে সব ধরনের খাবার খেতে পারেন কেবল একটি বিশেষ গাছের ফল ছাড়া। ওই গাছের কাছে যাওয়াটা হবে ক্ষতিকারক। কিন্তু শয়তান তাদের দুজনকেই ধোঁকা দিয়ে তাঁদেরকে নিষিদ্ধ ফল খেতে বাধ্য করে। ফলে তাঁদের নগ্নতা পরস্পরের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের ঢাকার চেষ্টা করেন এবং তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করে দেন এবং পৃথিবীতে পাঠান। পার্থিব জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁরা মহান আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীতেই ছিলেন।  তাই এটা স্পষ্ট শয়তান কেবল হাওয়াকে নয় হাওয়া ও আদম দুজনকেই ধোঁকা দিয়েছিল। ফলে দু'জনই এক্ষেত্রে সমানভাবে দোষী।  শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলেছিল তারা যদি ওই গাছের ফল খান তাহলে তারা অমরত্ব লাভ করবেন! অন্যদিকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিকৃত হয়ে পড়া ধর্মগ্রন্থে বলা হয় যে বিবি হাওয়াকেই শয়তান ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছিল! 

পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী বিবি হাওয়া ও হযরত আদম- উভয়ই ভুল কাজটি করে ফেলার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং মহান আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করে দেন। সুরা আ'রাফ-এর ২৩ নম্বর আয়াত অনুযায়ী তাঁরা বলেছিলেন:  হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যাব।

বলা হয় তাঁরা মহানবীর আহলে বাইতের মহান পাঁচ সদস্যের  নাম ও ফজিলত জানতে পেরে তাদের নামের উসিলায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।  তাই শয়তানের ধোঁকার ঘটনার জন্য কেবল বিবি হাওয়াই দায়ী ছিলেন এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল বা শয়তানেরই প্রচারণা মাত্র। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।