মে ১০, ২০২৩ ১৭:২০ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের প্রখ্যাত মনীষী খাজা নাসির উদ্দিন তুসির জীবনের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলাম। আমরা জেনেছি, খাজা নাসির উদ্দিন তুসি নিশাপুরে যখন পড়াশুনা শেষ করছিলেন তখন মোঙ্গল হামলার শিকার হয় এই শহর। মোঙ্গলদের বাগদাদ বিজয় সম্পন্ন হলে তুসিকে উত্তরপূর্ব ইরানের মারাগেহ শহরে একটি মানমন্দির বা মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন খাজা নিজেই এই মানমন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ ধরনের মানমন্দির নির্মাণের নানা কল্যাণ ও সুবিধা সম্পর্কে হালাকু খানকে অবহিত করেছিলেন খাজা নাসির উদ্দিন। হালাকু খান প্রকল্পটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে জানা সত্ত্বেও খাজার পরামর্শ গ্রহণ করে। অবশ্য অন্য একদল ঐতিহাসিক মনে করেন এই মানমন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনাকারী ছিলেন মোঙ্গল শাসক মানাকু কাআন। এই মানাকু কাআনই হালাকুকে ইরান আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা আরও মনে করেন হালাকু ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক এবং হালাকু নিজে ইউক্লিডিয় জ্যামিতিতে কিছুটা দক্ষ ছিলেন। মানাকু খাজার ব্যাপক জ্ঞানের কথা জানতে পেরে তাকে মঙ্গোলিয়ায় পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ পাঠান হালাকুর কাছে যাতে সেখানে একটি মানমন্দির নির্মাণ করা যায়।

কিন্তু মঙ্গোল শাসক সে সময় দক্ষিণ চীনে অভিযান চালানোর কথা ভাবছিলেন। আর হালাকু খাজা নাসির উদ্দিনের গভীর জ্ঞানের ব্যাপারে আস্থাশীল ছিল বলে মোঙ্গল রাজা ইরানেই ওই মানমন্দির নির্মাণ করা বেশি যৌক্তিক হবে বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। মারাগেহ শহরের একটি পাহাড়ের ওপর ওই মানমন্দির নির্মাণের জায়গা ঠিক করা হয়। খাজা নাসির উদ্দিনের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী এই মানমন্দির নির্মাণের জন্য সে যুগের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার বা স্থাপত্যবিদ আবুল সা’দাত আহমাদ ইবনে ওসমান মারাকিহকে নিয়োগ দেয়া হয়।

এই মানমন্দিরের উন্নয়নের কাজও সরকারি অর্থে পরিচালিত হত। মানমন্দিরের নির্মাণ কাজ তদারকের জন্য খাজা তিন বার সফর করেছিলেন। এইসব সফরে তিনি ওই মানমন্দিরের জন্য কয়েকটি বই ও পর্যবেক্ষণের যন্ত্রপাতিও সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জন্য জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যবহৃত কয়েকটি সারণিও রচনা করেন।

খাজা নাসির উদ্দিনের তৈরি-করা জ্যোতির্বিদ্যার সারণিগুলো ছিল মানের দিক থেকে অনন্য। মারাগেহ’র মানমন্দিরে কাজ করেছেন বিপুল সংখ্যক গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সুবিধার একটি বড় দিক ছিল এটা যে এখানে একটি বড় লাইব্রেরি ছিল যাতে চার লাখেরও বেশি বই ছিল। এই বইগুলোতে ছিল শিক্ষামূলক নানা বিষয়। খাজা নাসির উদ্দিন তার এই বিজ্ঞান-গবেষণাগার ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ব্যবহার করতে বিশ্বের নানা দেশের জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

খাজা নাসির উদ্দিনের এই প্রতিষ্ঠানে মূলত তাত্ত্বিক বিজ্ঞান ও গণিতের ওপর জোর দেয়া হত যা জ্যোতির্বিদ্যার মূল ভিত্তি। এখানে দর্শনের ছাত্রদেরকে দৈনিক তিন দিরহাম, চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্রদের দুই দিরহাম এবং ধর্মতত্ত্বের ছাত্রদের দেয়া হত এক দিরহাম। আর হাদিসের ছাত্রদের দেয়া হত দৈনিক আধা দিরহাম। খাজার উদ্যোগে চালু হওয়া এই বৃত্তি ১৩ বছর পর্যন্ত চালু ছিল।

খাজা নাসির উদ্দিনের বিজ্ঞান-কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই মারা যায় হালাকু খান। ফলে রাজ-সিংহাসনে বসেন যুবরাজ। প্রথম দিকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এই যুবরাজ। কিন্তু খাজার চেষ্টা ও পরামর্শে যুবরাজ ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর এর পাশাপাশি মানমন্দির নির্মাণের কাজ চালিয়ে যান খাজা ও তার সহকর্মীরা। খাজা নাসির উদ্দিন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই গবেষণা-কেন্দ্রের তৎপরতাকে সম্ভাব্য যে কোনো বাধা ও বিপত্তি থেকে রক্ষার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করে যান।

খাজা নাসির উদ্দিন তার সমস্ত প্রবন্ধ বা পুস্তিকা লিখেছিলেন আরবি ভাষায়। জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতার দিক থেকে এই মহান মনীষীর জ্ঞানকে ইরানের মনীষী ইবনে সিনার সঙ্গে তুলনা করা হয়। এ দু’জনের মধ্যে ইবনে সিনা চিকিৎসা শাস্ত্রে বেশি পারদর্শী ছিলেন। অন্যদিকে খাজার দক্ষতা বেশি মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল গণিতে। গণিতের নানা বিষয়ে বেশ কয়েকটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন খাজা নাসির উদ্দিন।

জার্মান প্রাচ্যবিদ কার্ল ব্রোকেলম্যান মনে করেন খাজা বড় ধরনের অবদান রেখেছেন গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায়। কার্ল ব্রোকেলম্যান তার বইয়ে এটাও উল্লেখ করেছেন যে খাজা নাসির উদ্দিন বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনেক বই অনুবাদ করেছিলেন এবং তিনিই প্রথমবারের মত ত্রিকোনোমিতিকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেন।  জ্যোতির্বিদ্যার ওপরও কয়েকটি মূল্যবান রচনা রেখে গেছেন ইরানের এই মনীষী। গণিত বিষয়ে খাজার বইগুলো মুসলিম পণ্ডিত বা আলেমদের শিক্ষা-কারিকুলামে স্থান পেয়েছিল। খাজা নাসির উদ্দিনের কোনো কোনো মূল্যবান বই অনুদিত হয়েছিল কয়েকটি বিদেশী ভাষায়। ফলে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা উপকৃত হয়েছিলেন এইসব বই থেকে।

তিনি ইউক্লেডিয় জ্যামিতির মূল নীতির বিষয়ে একটি ব্যাখ্যামূলক বই লিখেছিলেন। বইটি অক্ষত অবস্থায় আজও টিকে আছে। গ্রিক পণ্ডিত ইউক্লিডের জ্যামিতি বিষয়ক বই আব্বাসিয় খলিফার যুগে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল কয়েক ব্যক্তির অনুবাদের সুবাদে। আর ওই অনুবাদের আলোকে খাজা নাসির উদ্দিন বইটির ব্যাখ্যা ও পুনর্লিখন সম্পন্ন করেন।

প্রখ্যাত মার্কিন ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, খাজা নাসির উদ্দিনের এই ব্যাখ্যামূলক বই ও ইউক্লিডের প্রতি তার অনুসরণের সুবাদে শত শত বছর ধরে প্রখ্যাত গণিতবিদরাও গণিতের এই দিকপালকে অনুসরণ করেছেন।

 ‘জিজে ইলখানি’ বা ‘ইলখানি সারণী’ খাজা নাসির উদ্দিনের একটি বিখ্যাত বই। বইটি তিনি লিখেছেন ফার্সি ভাষায়। জিজ বলতে জ্যোতির্বিদরা গ্রহ-নক্ষত্রসহ আকাশের নানা বস্তুর অবস্থা আর গতিবিধির বর্ণনাকে বোঝান যা তারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করেন। খাজা মহাকাশ-পর্যবেক্ষণ করে নানা সময়ে যা দেখেছেন তা লিখেছেন এ বইটিতে।

‘আখলাকে নাসিরি’ বা ‘নাসিরি নৈতিকতা’ খাজা নাসির উদ্দিনের লেখা আরেকটি বিখ্যাত বই। ব্যবহারিক প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার বিষয়ে কুহেস্তান তথা দক্ষিণ খোরাসানের তৎকালীন শাসক মোহতাশামের অনুরোধেই খাজা এ বইটি লিখেছিলেন। অত্যন্ত সারগর্ভ এ বইয়ে চরিত্রকে উন্নত করা এবং পরিবার ও রাষ্ট্র-পরিচালনার বিষয়ে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বদের মতামতের পাশাপাশি এসব বিষয় উপলব্ধির জন্য সহায়ক প্রাচ্যের দর্শনও তুলে ধরা হয়েছে আকর্ষণীয় ও সর্বোত্তম পন্থায়।

চিকিৎসা বিষয়েও কয়েকটি বই লিখেছিলেন খাজা নাসির উদ্দিন। তবে খাজা গণিত, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে যত গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন ততটা গভীর মাত্রায় মনোনিবেশ করেননি চিকিৎসা বিদ্যার দিকে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ