মে ২০, ২০২৩ ১৯:০৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো যে, আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে গেছে। হিংসা একটি ধ্বংসাত্মক কু-অভ্যাস। মানুষকে কলুষিত করার জন্য এই একটি বদঅভ্যাসই যথেষ্ট।

মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকুক এবং মানব সমাজে সামাজিক শান্তি-সম্প্রীতি বজায় থাকুক এটাও আল্লাহতায়ালার একান্ত অভিপ্রায়। তাইতো তিনি পবিত্র কুরআনের সুরা আন-নিসার ৫৪নং আয়াতে বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’

অন্যদিকে সূরা ফালাকের ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, "(আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।"

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, একজন প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি কখনো হিংসুটে হতে পারেন না। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মোমিন বান্দার পেটে আল্লাহর রাস্তার ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন একত্রে জমা হতে পারে না।' বিশ্বনবী বলেছেন- 'সন্দেহ নেই, হিংসা নেক আমলসমূহের নূর ও আলোকে নিভিয়ে দেয়।'  নবীজি আরও বলেছেন, কোনো বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না।  

বন্ধুরা, আমরা সবাই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করব- এ কামনায় নজর দিচ্ছি রংধনুর আজকের আসরের দিকে। আসরের শুরুতেই থাকবে একটি হিংসুটে চাষির গল্প। বুলগেরিয়ায় প্রচলিত গল্পটি অনুবাদক করেছেন কবি হাসান হাফিজ। গল্পের পর থাকবে একটি ছড়া ও একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

গ্রামের এক চাষিকে নিয়ে গল্প। বেচারা ভীষণ গরিব। দিন আনে দিন খায়। কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চলে। অভাব লেগেই থাকে সারা বছর। সম্বল বলতে মাত্র ছোট্ট এক টুকরা জমি। এতে যে শাকসবজি ফলে, তা বেচে দিন গুজরান করা কঠিন। আয়-রোজগারের অন্য কোনো উপায়ও নেই। সুতরাং ভীষণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কাটে তার ও পরিবারের সবার জীবন।

চাষি লোকটি গরিব হলে কী, তার স্বভাব বিশেষ সুবিধার নয়। সে দারুণ হিংসুটে লোক। পড়শি অন্য কোনো লোকের সৌভাগ্য দেখলে সে কষ্ট পায়। মনের ভেতরে অনেক জ্বালাযন্ত্রণা হয়। সেটা আবার মুখ ফুটে বলেও ফেলে। আশপাশের মানুষেরা এটা বেশ ভালো করেই জানে। তারা চাষি লোকটাকে পছন্দ করে না। একদমই না। ওকে এড়িয়ে চলে সব সময়। দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। শুধুই কি পাড়াপড়শি? না। কোনো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও তার সামান্যতম বনিবনা নেই। সে একজন একঘরে মানুষ।

এভাবেই দিনকাল কাটছিল। চাষি লোকটার বয়স হয়েছে। শরীরে জোর নেই আগের মতো। যথেষ্ট খাটাখাটনি করতে পারে না তাই। চাষবাসের কাজ বেশ কঠিন। টানা মেহনত না করতে পারলে ভালো ফসল আশা করা যায় না। জমি চাষ করার জন্য গরু লাগে। এই চাষির তা নেই। গরু কিনতে হলে অনেক টাকা দরকার। সেই টাকা কে দেবে?

জমিতে সেচ দিতে হয় অনেক সময়। আশপাশে কোনো কুয়ো বা পুকুর নেই। পানি পাওয়া যাবে কোত্থেকে? অতএব বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা। সময়মতো বৃষ্টি না হলে? কম্ম কাবার। চাষির তখন মাথায় হাত। ফসল না পেলে দুঃখকষ্টের সীমা শেষ থাকে না। দুবেলা দুমুঠো খাবারই জোটে না। হায় রে পোড়া কপাল!

অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেল একদিন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। জমিতে কাজ সেরে বাড়িতে ফিরছিল চাষি। মহা ক্লান্ত। সারা দিন অনেক ধকল গেছে। এখন বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার পালা। পথে দেখা হলো একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে। তার মুখভরা সাদা দাড়ি। সুন্দর চেহারা। দেখলে মনে একরকম ভক্তি জেগে ওঠে। এই তল্লাটে আগে কোনো দিন একে দেখা যায়নি। মিষ্টি হেসে শান্ত মানুষটি চাষিকে ডেকে বলেন, 'এত মন খারাপ কেন তোমার? কিছু মনে না করলে আমাকে খুলে বলো। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ দেখছি। আহা রে বাছা। তোমাকে দেখে ভীষণ মায়া হচ্ছে আমার।’

চাষি জবাব দেয়, ‘আমার অভাব–অনটন ও কষ্টের কথা আপনাকে কী আর বলব! আমার দুর্ভাগ্যের অন্ত নেই। সেসব তেতো কথা শোনার মতো লোক এই দুনিয়ায় কেউ নেই। কোনো শান্তি–স্বস্তি নেই আমার জীবনে। সুখ তো দূরের কথা! পোড়া কপাল আমার।’

বুড়ো লোকটি দরদভরা কণ্ঠে বলেন, ‘আমি মন দিয়ে শুনব। তুমি বলো। তোমার কথা শোনার জন্যই আমি এখানে এসেছি। আমাকে বিশ্বাস করে তুমি সব কথা নিশ্চিন্তে বলতে পারো।’

বুড়ো চাষি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘আমি যে কত গরিব, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। কীভাবে বলি সেই সব কথা! লজ্জারও ব্যাপার। আমার যদি একটা গরু থাকত, জমিতে হালচাষ করে ভালো ফসল ফলানো যেত। যদি সেচের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আরও ভালো হতো।’

আগন্তুক মানুষটি বলেন, ‘আচ্ছা ধরো, একটা গরু তুমি এখনই পেয়ে গেলে। তারপর? কী করবে তুমি তারপর?’

চাষি এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না। সে বলল, ‘আসলেই যদি কোনোভাবে একটা গরু পেয়ে যাই? ওহ, তাহলে কোনো দুশ্চিন্তা আর থাকবে না। আমার মতো সুখী মানুষ তখন এই দুনিয়ায় আর কে? আমার খুশির কোনো সীমা থাকবে না তখন। সেটা কি আর কোনোকালে হবে? এমন আনন্দ এমন শান্তি কি আর এই জীবনে পাব? সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব না। এমন কিছু আশা করাও ভীষণ বোকামি।’

এই কথা শুনে বুড়ো মানুষটি চোখ বুজে কী সব মন্ত্র আওড়ালেন। তক্ষুনি একটা তরতাজা সবল গরু এসে হাজির হয়ে গেল ওখানে। এ কি ম্যাজিক নাকি? এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা দেখে চাষি হতবাক। তার মুখে কথা সরে না। এমনই তাজ্জব সে হয়েছে।

বুড়ো মানুষটি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এই নাও তোমার গরু। এটা নিয়ে বাড়ি চলে যাও। তোমার কষ্টের দিন শেষ হোক। আজ থেকেই হোক। এই আশীর্বাদ করছি তোমাকে।’

চাষি তো হতভম্ব। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। শূন্য থেকে এই গরু কেমন করে কীভাবে এখানে চলে এল!

বুড়ো মানুষটি চাষির মাথায় পরম স্নেহে, মমতায় হাত বুলিয়ে দেন। নরম কণ্ঠে বলেন, ‘এক কাজ করো তো বাপু। গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। গিয়ে তোমার প্রতিবেশীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। আমি তার জন্য এখানে অপেক্ষা করব।’

চাষি এমনধারা অদ্ভুত কোনো কথা শুনবে, মোটেও আশা করেনি। বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘আমাকে আপনি গরু উপহার দিলেন। আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার প্রতিবেশীকে আবার কেন? তার সঙ্গে আপনার কী দরকার? একটু কি বলা যায় সেটা?’

আগন্তুক এমন কিছু শুনবেন বলে যেন তৈরি হয়েই ছিলেন। চাষিকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই বলা যায়। তাকে আমি দুটো গরু উপহার দেব।’

চাষি তার স্বভাবমতো চটে যায়। স্বভাব কি কখনো বদলায় নাকি? আগন্তুকের কথা শুনে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। ফোঁস করে বলে সে, ‘আপনি জানেন না, আমার পড়শির সবকিছুই আছে। কোনো কিছুর কমতি নেই তার। আপনি তাকে দুটো গরু দিতে যাবেন কেন? সেটা তো তেলা মাথায় তেল দেওয়া হবে। কোনোমতেই উচিত হবে না সেটা। আপনার মতলব তো সুবিধার না। যান, আমি আপনার গরু নেব না। এই গরু এক্ষুনি ফিরিয়ে নিন।’

বুড়ো মানুষটি কী আর করেন। ব্যথিত হয়ে বলেন, ‘আচ্ছা বেশ। তাই হবে। তোমার সমস্যা কি জানো? গরিবি নয়। হিংসা। এই হিংসাই তোমার সর্বনাশ করল। এমন একটা দামি গরু তুমি নিজের দোষে হারালে। তোমার ভাগ্য তো কিছুতেই বদলাবে না। কোনো দিনও না।’

বুড়ো মানুষটি গরু নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর চাষি? মনমরা হয়ে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল। মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। নিজের বোকামি ও গা জ্বালানো হিংসার জন্য এমন বড় ও সুন্দর একটা সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে গেল।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে 'মেট্রোরেলের ছড়া'। কবি আসাদ বিন হাফিজের লেখা ছড়াটি আবৃত্তি করেছে ছোট বন্ধু জাকিয়া মাহজাবিন।

ছড়াটি শুনলে। বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি গান। একটি শিশুর দিনলিপি নিয়ে লেখা 'আমার সারাবেলা' শিরোনামের গানটির গীতিকার বিলাল হোসাইন নূরী, সুরকার মাহফুজ বিল্লাহ শাহী আর শিল্পী নাজিফা ইবনাত কবীর।

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।