কুরআনের আলো
সূরা আল-ওয়াকিয়া: আয়াত ৪১-৫৬ (পর্ব-৩)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। গত আসরে আমরা সূরা ওয়াকিয়ার ৪০ নম্বর পর্যন্ত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৪১ থেকে ৫৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই সূরা ওয়াকিয়ার ৪১ থেকে ৪৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَأَصْحَابُ الشِّمَالِ مَا أَصْحَابُ الشِّمَالِ (41) فِي سَمُومٍ وَحَمِيمٍ (42) وَظِلٍّ مِنْ يَحْمُومٍ (43) لَا بَارِدٍ وَلَا كَرِيمٍ (44) إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُتْرَفِينَ (45) وَكَانُوا يُصِرُّونَ عَلَى الْحِنْثِ الْعَظِيمِ (46)
“আর বাম দিকের দল [যাদের আমলনামা তাদের বাম হাতে দেওয়া হবে]; কত [হতভাগ্য] বাম দিকের দল!” ( ৫৬:৪১)
“[তারা থাকবে] অত্যন্ত উষ্ণ বায়ু ও উত্তপ্ত পানির মধ্যে।” ( ৫৬:৪২)
“আর প্রচন্ড কালো ধোঁয়ার ছায়ায়।” ( ৫৬:৪৩)
“যা শীতল নয়, আরামদায়কও নয়।” ( ৫৬:৪৪)
“ইতোপূর্বে তারা তো মগ্ন ছিল ভোগ-বিলাসে এবং ছিল দাম্ভিক ও অহংকারী।” ( ৫৬:৪৫)
“আর তারা অবিরাম লিপ্ত ছিল ঘোরতর পাপকাজে।” ( ৫৬:৪৬)
সূরা ওয়াকিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী কিয়ামতের দিন মানুষ তিন দলে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে প্রথম দুই দল অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তগণ ও সৌভাগ্যবানদের দল জান্নাতবাসী হবেন। এই দুই দল সম্পর্কে আগের দুই আসরে আলোচনা হয়েছে। আজ কিয়ামতের দিনের তৃতীয় দলটি সম্পর্কে বলা হচ্ছে: যাদের আমলনামা তাদের বাম হাতে দেওয়া হবে তারা জাহান্নামবাসী এবং জাহান্নামে যাওয়ার চেয়ে ঘোরতর বিপদ আর মানুষের জন্য হতে পারে না। জান্নাতবাসী অসংখ্য নিয়ামতে ভরা উদ্যানে সুখে জীবন কাটাতে থাকলেও জাহান্নামবাসী জ্বলন্ত অগ্নি থেকে সৃষ্ট কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। তাদেরকে পান করার জন্য যে ফুটন্ত পানি দেওয়া হবে তাতে তাদের পিপাসা নিবৃত্ত হওয়ার পরিবর্তে তৃষ্ণা আরো বেড়ে যাবে।
এরপর তাদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে: তারা পার্থিব জগতে তাদের সম্পদ ও ক্ষমতার মোহে এতটা মত্ত ছিল যে, রাসূলের বাণী ও আসমানি কিতাবের বক্তব্য তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। এ কারণে দুনিয়ার যত খারাপ কাজ আছে সেগুলো তাদের ভালো লাগত এবং জঘন্য অপরাধ করাকে অভ্যাসে পরিণত করেছিল।
এই ছয় আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
১- অতিরিক্ত যে ভোগবিলাস মানুষকে আল্লাহ ও পরকালের স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে তা মানুষের জন্য মহাদুর্ভোগ বয়ে আনবে।
২- একজন মানুষ গোনাহ করে ফেললেই জাহান্নামে চলে যায় না, কারণ তার সামনে তওবা করে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গোনাহের কাজে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। কারণ ওই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আর মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না এবং এই অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায়।
৩- দম্ভ ও অহংকার মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে।
এবারে এই সূরার ৪৭ থেকে ৫০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَكَانُوا يَقُولُونَ أَئِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَئِنَّا لَمَبْعُوثُونَ (47) أَوَآَبَاؤُنَا الْأَوَّلُونَ (48) قُلْ إِنَّ الْأَوَّلِينَ وَالْآَخِرِينَ (49) لَمَجْمُوعُونَ إِلَى مِيقَاتِ يَوْمٍ مَعْلُومٍ (50)
“আর তারা বার বার একথা বলত: মরে [পঁচা] অস্থি ও মাটিতে পরিণত হলেও কি আমাদেরকে উঠানো হবে?” ( ৫৬:৪৭)
“এবং আমাদের পিতৃপুরুষরাও [কি পুনরুত্থিত হবে]?( ৫৬:৪৮)
“বলুন, সত্যি সত্যিই পূর্ববর্তীরা ও পরবর্তীরা।”( ৫৬:৪৯)
“সবাইকে নিশ্চিতভাবে একত্র করা হবে এক নির্ধারিত দিনের নির্দিষ্ট সময়ে।”( ৫৬:৫০)
জাহান্নামীদের এই কঠিন পরিণতির আরেকটি কারণ হচ্ছে, তারা কিয়ামত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বক্তব্য নিয়ে উপহাস করত। তারা বলত: আমাদের পূর্বপুরুষদের দেহ মাটির নীচে পঁচে গলে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। মাটিতে পরিণত হয়ে যাওয়া ওই দেহগুলো কীভাবে জীবিত হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছে, মহাশক্তিধর আল্লাহ তায়ালার কাছে এটি অত্যন্ত সহজ কাজ; কাজেই আল্লাহর এই প্রতিশ্রতি বাস্তবায়িত হবেই। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে তাদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত করা হবে।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- পরকালে অবিশ্বাসকারীদের কাছে তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। তারা যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়াই কেবল নিজেদের ধারনার ভিত্তিতে কিয়ামতকে অসম্ভব বিষয় বলে মনে করে।
২- কেউ কেউ কিয়ামত সম্পর্কে নিজেদের ভ্রান্ত ধারনা সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবে মুমিন ব্যক্তিদের কর্তব্য হচ্ছে এ ধরনের সংশয় ও সন্দেহ দূর করে মানুষের মনে কিয়ামত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা তৈরি করে দেওয়া।
এবারে সূরা ওয়াকিয়াহর ৫১ থেকে ৫৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
ثُمَّ إِنَّكُمْ أَيُّهَا الضَّالُّونَ الْمُكَذِّبُونَ (51) لَآَكِلُونَ مِنْ شَجَرٍ مِنْ زَقُّومٍ (52) فَمَالِئُونَ مِنْهَا الْبُطُونَ (53) فَشَارِبُونَ عَلَيْهِ مِنَ الْحَمِيمِ (54) فَشَارِبُونَ شُرْبَ الْهِيمِ (55) هَذَا نُزُلُهُمْ يَوْمَ الدِّينِ (56)
“তারপর হে পথভ্রষ্ট ও অস্বীকারকারীরা।” ( ৫৬:৫১)
“তোমরা অবশ্যই জাক্কুম গাছ থেকে আহার করবে।”( ৫৬:৫২)
“এবং ওটা দ্বারা তোমরা উদর পূর্ণ করবে।”( ৫৬:৫৩)
“আর তার উপর পান করবে ফুটন্ত পানি।”( ৫৬:৫৪)
“অতঃপর তোমরা তা পান করবে তৃষ্ণার্ত উটের ন্যায়।”( ৫৬:৫৫)
“কিয়ামত দিবসে ওটাই হবে তাদের [প্রথম] আপ্যায়ন।”( ৫৬:৫৬)
আগের আয়াতগুলোতে জাহান্নামবাসীর অবস্থা বর্ণনা করার পর এই আয়াতগুলোতে তাদের পানাহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, জান্নাতবাসীকে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার দ্বারা আপ্যায়ন করা হলেও জাহান্নামবাসীকে দেখতে অতি বীভৎস খেতে অতি বিস্বাদ ও তিক্ত জাক্কুম বৃক্ষের ফল দেওয়া হবে। এই খাবার তাদের কাছে অতি অপ্রীতিকর হলেও প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালায় তাই দিয়েই তারা উদর পূর্ণ করবে। ওই ফল খাওয়ার পর তাদের এত পীপাসা লাগবে যে, তৃষ্ণার্ত উটের মতো ফুটন্ত পানি খেতে থাকবে। এতে তাদের নাড়িভুড়ি প্রচণ্ড গরমে জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে গেলেও তাদের পানি খাওয়া বন্ধ হবে না, কারণ ওই পানি তাদের পীপাসা নিবৃত্ত করতে পারবে না। অবশ্য এই শাস্তি হবে তাদের যারা সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও দম্ভ ও গোয়ার্তুমির কারণে তা গ্রহণ করেনি। তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আরো বহু মানুষকে সত্য গ্রহণ থেকে বিরত রেখেছে।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা প্রথমে পথভ্রষ্ট থাকলেও পরবর্তী জীবনে সত্য গ্রহণ করে পরকালীন মুক্তি পেয়ে যায়। এখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, সত্য উপলব্ধি করার পরও তা প্রত্যাখ্যান করা।
২- সবচেয়ে বড় কথা মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারক এবং তিনি কারো প্রতি জুলুম করবেন না। জাহান্নামবাসী যত আজাবের মধ্যেই থাকুক তা জুলুম নয় বরং পার্থিব জীবনে তাদের অন্যায় কর্মেরই পরিণতি।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।