জুন ০৩, ২০২৩ ১৯:৫৫ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা ওয়াকিয়ার ৭৪ নম্বর পর্যন্ত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৭৫ থেকে ৯৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই এই সূরার ৭৫ থেকে ৮২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ (75) وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ (76) إِنَّهُ لَقُرْآَنٌ كَرِيمٌ (77) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (78) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (79) تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (80) أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ (81) وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ (82)

“অতঃপর আমি শপথ করছি নক্ষত্ররাজির অবস্থানের!” ( ৫৬:৭৫)

“অবশ্যই এটা এক মহা শপথ, যদি তোমরা জানতে।” ( ৫৬:৭৬)

“নিশ্চয় এটা মহিমান্বিত কুরআন।” ( ৫৬:৭৭)

“যা আছে আচ্ছাদিত [ও সুরক্ষিত] কিতাবে।” ( ৫৬:৭৮)

“[সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে] পূত-পবিত্রগণ ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না।” ( ৫৬:৭৯)

“এটা বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ।” ( ৫৬:৮০)

“তবুও কি তোমরা এই বাণীকে তুচ্ছজ্ঞান করবে?” ( ৫৬:৮১)

“আর তাকে মিথ্যে বলাকেই তোমরা তোমাদের জীবিকা বানিয়ে নিয়েছ?” ( ৫৬:৮২)

গত কয়েক আসরে আমরা কাফিরদের পক্ষ থেকে কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করা নিয়ে আলোচনা করেছি। কিয়ামত সম্পর্কে জানার একমাত্র মাধ্যম হলো নবী-রাসূলগণের ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণী। কাজেই যারা আল্লাহর বাণী বা ওহীতে বিশ্বাস করে না তারা কিয়ামতেও বিশ্বাসী নয়। আজকের এই আয়াতগুলো আকাশের নক্ষত্ররাজির অবস্থানের শপথ বর্ণনা করে শুরু হয়েছে। বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে একথা প্রমাণিত যে, মহাকাশে যে হাজার হাজার বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটির সুনির্দিষ্ট অবস্থান রয়েছে।  এসব নক্ষত্র শূন্যে ভাসমান অবস্থায় নির্দিষ্ট কক্ষপথে যাতায়াত করে। এগুলোর কক্ষ এবং গতিপথ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব-নিকাষের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমাদের সৌরজগত। বিজ্ঞানীরা বলেন, সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহগুলোর ব্যবস্থাপনা এতটা সূক্ষ্ম যে, তা যেকোনো চিন্তাশীল মানুষকে বিস্মিত ও হতবাক করে। মহাকাশে সূর্যের মতো এরকম হাজার হাজার বিলিয়ন নক্ষত্র এবং সেগুলোকে কেন্দ্র করে এক একটি সৌরজগত গঠিত হয়েছে। এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে এই নক্ষত্ররাজির অবস্থানের যে শপথ আল্লাহ তায়ালা করেছেন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করা সহজ হবে এবং এটি পবিত্র কুরআনের অন্যতম মুজিযা বা অলৌকিকত্ব।

এরপর পবিত্র কুরআনের মাহাত্ম্য ও এর সমুন্নত শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: যে আল্লাহ মহাবিশ্বের এত এত নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন তিনিই মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। মানুষকে মানবীয় গুণে গুণান্বিত করে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই মহাগ্রন্থে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। আর এতে তোমরা কোনো ভুল খুঁজে পাবে না। তবে এই গ্রন্থ থেকে শুধুমাত্র মুত্তাকিরা হেদায়েত পাবে। যাদের অন্তর পাপাচারে পরিপূর্ণ এবং দম্ভ ও গোঁয়ার্তুমিতে ভরা তারা পবিত্র কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারবে না।

এসব আয়াতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে:

১- মহান আল্লাহ একদিকে যেমন হাজার হাজার কোটি নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন তেমনি তিনি মানুষকে হেদায়েত করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। পরিচ্ছন্ন অন্তর নিয়ে কুরআনে কারিম অধ্যয়ন করলে ঈমানদার মাত্রই সঠিক পথ পেয়ে যাবে।

২- পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহর কালাম। শুধুমাত্র কিছু শব্দ ও বাক্যের সমম্বয়ে লিখিত একটি গ্রন্থ নয় বরং এর বিষয়বস্তু সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যা সংরক্ষিত রয়েছে আল্লাহর কাছে লৌহে মাহফুজে। এই কুরআন সব ধরনের অপবিত্র কথা ও বাক্য থেকে মুক্ত এবং মুমিন ব্যক্তিদের সম্মান ও মর্যাদা অর্জনের মাধ্যম।

৩- নানা ধরনের পাপকাজে পূর্ণ কলুষিত অন্তরের পক্ষে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ধারণ করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পবিত্র আত্মার অধিকারী মুমিন ব্যক্তিরা এই মহাগ্রন্থ থেকে উপকৃত হতে পারবে।

৪- পবিত্র কুরআনের শিক্ষাকে তুচ্ছজ্ঞান করলে মানুষ কিয়ামতে অস্বীকারকারী হয়ে যায়।  (তাওয়াশিহ)

এবারে সূরা ওয়াকিয়াহর ৮৩ থেকে ৮৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لَا تُبْصِرُونَ (85) فَلَوْلَا إِنْ كُنْتُمْ غَيْرَ مَدِينِينَ (86) تَرْجِعُونَهَا إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (87)

“তাহলে কেন [তোমরা বাধা দাও না] যখন [প্রাণ] এসে যায় কণ্ঠনালীতে?” ( ৫৬:৮৩)

“এবং তখন তোমরা [শুধুমাত্র] তাকিয়ে থাক [এবং তোমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয় না]।”( ৫৬:৮৪)

“আর আমি তোমাদের অপেক্ষা তার [অর্থাৎ প্রাণের] অধিক নিকটতর, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না।”( ৫৬:৮৫)

“সুতরাং তোমরা যদি [তোমাদের কৃতকর্মের জন্য] শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত না হও।”( ৫৬:৮৬)

“তাহলে তোমরা তাকে [অর্থাৎ প্রাণকে মৃত্যুর সময়] ফিরিয়ে নাও না কেন যদি তোমরা [তোমাদের দাবীতে] সত্যবাদী হয়েই থাক?( ৫৬:৮৭)

এই আয়াতগুলোতে আবারও মৃত্যুর মুহূর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে: তোমাদের জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে এবং তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় হয়ে গেলে কারো পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং সবকিছুকে মানুষের আয়ত্বাধীন মনে করে তাদের পক্ষে কি মৃতপ্রায় কোনো মানুষের মৃত্যু ঠেকিয়ে রেখে তাকে নবজীবন দান করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে মানুষ কেন একথা স্বীকার করে না যে, সে আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তার শক্তির বাইরে যাওয়ার অধিকার তার নেই?

এসব আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- যে আল্লাহ মানুষের মৃত্যু চাইলে কারো পক্ষে তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয় সেই আল্লাহই কিয়ামতের দিন মানুষকে আবার জীবিত করবেন এবং সেদিনও কারো পক্ষে তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

২- মৃত্যুর সময় আল্লাহ তায়ালা মানুষের নিকটজনদের চেয়েও নিকটে থাকেন। তবে তা অন্যরা বুঝতে পারে না।  (তাওয়াশিহ)

এবারে সূরা ওয়াক্বিয়াহর ৮৮ থেকে ৯৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

فَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنَ الْمُقَرَّبِينَ (88) فَرَوْحٌ وَرَيْحَانٌ وَجَنَّةُ نَعِيمٍ (89) وَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ الْيَمِينِ (90) فَسَلَامٌ لَكَ مِنْ أَصْحَابِ الْيَمِينِ (91) وَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنَ الْمُكَذِّبِينَ الضَّالِّينَ (92) فَنُزُلٌ مِنْ حَمِيمٍ (93) وَتَصْلِيَةُ جَحِيمٍ (94) إِنَّ هَذَا لَهُوَ حَقُّ الْيَقِينِ (95) فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ (96)

“অতঃপর যদি সে নৈকট্যপ্ৰাপ্তদের একজন হয়।”( ৫৬:৮৮)

“তবে তার জন্য থাকবে আরাম, উত্তম জীবনোপকরণ ও সুখময় জান্নাত।”( ৫৬:৮৯)

“আর যদি সে সৌভাগ্যবানদের একজন হয়।”( ৫৬:৯০)

“[তাকে বলা হবে] সৌভাগ্যবানদের পক্ষ থেকে তোমাকে সালাম।”( ৫৬:৯১)

“কিন্তু সে যদি অস্বীকারকারী ও বিভ্রান্তদের একজন হয়।”( ৫৬:৯২)

“তবে তার আপ্যায়ন হবে ফুটন্ত পানি দিয়ে।”( ৫৬:৯৩)

“এবং [তার শাস্তি হবে] জাহান্নামে প্রবেশ।”( ৫৬:৯৪)

“নিশ্চয় এটি অবধারিত সত্য।”( ৫৬:৯৫)

“অতএব আপনি আপনার মহান রবের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।”( ৫৬:৯৬)

এই সূরার শুরুতে মানুষকে নৈকট্যপ্রাপ্ত, সৌভাগ্যবান ও পথভ্রষ্ট এই তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। সূরার এই শেষ আয়াতগুলোতেও একই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: মৃত্যুর সময় বারযাখি জীবনের শুরু থেকেই এই তিন দলের পরিণতি তিন রকমের হবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।

যেসব ঈমানদার মানুষ পৃথিবীতে সৎকাজে অগ্রগামী থেকেছে তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত এবং তারা মৃত্যুর মাধ্যমে দুনিয়ার কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পাবেন। তাদেরকে জান্নাতের আরাম আয়েশ উপভোগ করতে দেওয়া হবে। আর সৌভাগ্যবানরা সৌভাগ্যবানদের সঙ্গে মিলিত হবেন এবং তাদেরকে সালাম দিয়ে সম্ভাষণ জানানো হবে।

কিন্তু কিয়ামতকে অস্বীকারকারীরা বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্টতায় মগ্ন ছিল বলে মৃত্যুর মুহূর্ত থেকেই তারা পীড়াদায়ক শাস্তির সম্মুখীন হবে। তাদের এ শাস্তি কিয়ামত পর্যন্ত চলবে এবং কিয়ামতের দিনও তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এই সূরায় কিয়ামত সম্পর্কে যা কিছু বলা হলো তার সবই অবধারিত সত্য এবং ঈমানদার মানুষেরা তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তারা আল্লাহকে সব ধরনের জুলুমের ঊর্ধ্বে মনে করে এবং আল্লাহর তসবীহ পাঠ করে অর্থাৎ তাঁর প্রশংসা ও মহীমা ঘোষণা করে।

সূরা ওয়াক্বিয়াহর এই শেষ আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- বেশিরভাগ মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় এবং একে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা বলে মনে করে। কিন্তু আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের জন্য মৃত্যু অনেকগুলো নেয়ামত ভোগ করতে যাওয়ার দরজা ছাড়া আর কিছু নয়।  মৃত্যুর মাধ্যমে তারা দুনিয়াবি দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পান এবং জান্নাতের অফুরন্ত আরাম-আয়েশে প্রবেশ করেন।

২- মৃত্যুর মুহূর্ত থেকে পূণ্যবান ও পাপী ব্যক্তিদের পুরস্কার ও শাস্তি শুরু হয়ে যায় যা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ