জুন ০৮, ২০২৩ ১৪:১৯ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাদিদের ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ১০ থেকে ১৫ নম্বর আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (10) مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ وَلَهُ أَجْرٌ كَرِيمٌ (11)

“তোমরা কেন আল্লাহর পথে খরচ করো না? অথচ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানা তো আল্লাহরই।  তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে খরচ ও সংগ্রাম করেছে তারা [অন্যদের] সমান নয়।  তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।  আর তোমরা যা করো, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত।”  (৫৭:১০)

“কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি তা বহুগুণে তার জন্য বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” (৫৭:১১)

আগের আসরে আমরা বলেছি, আল্লাহর প্রতি ঈমানের কিছু শর্ত রয়েছে এবং এসব শর্তের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় দান করা অন্যতম। আজকের এই দুই আয়াতে দু’টি বিষয়ের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রথমত, যারা চরম সংকটময় ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিজেদের জান ও মাল আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে এবং ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করে, তারা তাদের চেয়ে উত্তম যারা শান্তিময় পরিস্থিতিতে অর্থাৎ মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা থাকার সময়ে দান করে ও জিহাদে অংশ নেয়। দ্বিতীয়ত, তোমরা যা কিছু দান করো সেসব আল্লাহর কাছে জমা থাকে এবং কিয়ামতের দিন তিনি এসব দান বহুগুণে বৃদ্ধি করে তোমাদেরকে ফেরত দেবেন। অথবা কোনো অভাবী মানুষকে তোমরা যে ঋণ দাও আল্লাহ বলছেন সেটি যেন তোমরা ওই অভাবীকে না দিয়ে বরং আল্লাহকেই দিচ্ছো।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মুসলিম যোদ্ধাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দান ও জালেমের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করা ঈমানের পূর্বশর্ত।

২- কঠিন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি মূল্যবান। পরিস্থিতি যত কঠিন হবে দায়িত্ব পালনের মর্যাদাও তত বেড়ে যাবে।

৩- কোনো ভালো কাজের বাহ্যিক রূপটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মাপকাঠি নয়। কখনও এমন হতে পারে যে, দৃশ্যত একটি ভালো কাজ সবাই সমানভাবে করেছে কিন্তু তারা সমান পুরস্কার পায়নি। কারণ, কে কোন উদ্দেশ্যে বা নিয়তে কাজটি করেছে সেটির বিচারে আল্লাহ তায়ালা পুরস্কার দিয়েছেন।

৪- দান করার পাশাপাশি অভাবী মানুষকে ঋণ দেয়াও ইসলামের অন্যতম রীতি। ঋণ দিলে সম্পদে বরকত বৃদ্ধি পায়।

এবারে সূরা হাদিদের ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (12) يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آَمَنُوا انْظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُورِكُمْ قِيلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُورًا فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُورٍ لَهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ (13)

“সেদিন আপনি দেখবেন মুমিন নর-নারীদেরকে তাদের সামনে ও ডানে তাদের নূর ছুটতে থাকবে।  [তাদেরকে বলা হবে:] আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার [গাছপালার] পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে, এটাই তো মহাসাফল্য।” (৫৭:১২)

“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা ঈমানদারদের বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি! তাদের বলা হবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও [পৃথিবীতে] নূরের সন্ধান কর। তারপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, যার ভিতরে থাকবে [জান্নাতের] রহমত এবং বাইরে থাকবে [জাহান্নামের] শাস্তি।” (৫৭:১৩)

এই দুই আয়াতে কিয়ামতের কঠিন দিনে মুমিনের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন মুমিন ব্যক্তিদের ঈমান নূর বা আলো আকারে প্রতিভাত হবে। এই নূর মুমিনের আগে আগে এবং ডান দিক দিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান হবে এবং মুমিন ব্যক্তিকে জান্নাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অবশ্য এই নূর যেহেতু ঈমান ও সৎকর্মের প্রতিদান তাই ঈমান ও সৎকর্মের পরিমাণ অনুযায়ী এই নূরের তারতম্য হবে। যাদের ঈমান অনেক শক্তিশালী তাদের নূরে অনেক দূর পর্যন্ত আলোকিত হবে। পক্ষান্তরে যাদের ঈমানের জোর কম তাদের আলো বেশিদূর নিক্ষিপ্ত হবে না।

কিন্তু কুফরি ও নিফাকি কঠিন অন্ধকারেরই নামান্তর। কিয়ামতের দিন এই দুই দোষ সত্যিকার অর্থে অন্ধকার হয়ে ধরা দেবে। কাজেই পৃথিবীতে যাদের অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র নেই বরং মুসলমানদের সহানুভূতি আদায়ের জন্য মুমিন হওয়ার ভান করে তারা কিয়ামতের দিন ঘোরতর অন্ধকারে পড়ে থাকবে এবং নূরের সন্ধানে ছোটাছুটি করবে।

তারা মুমিন ব্যক্তিদের হাতে-পায়ে ধরে তাদের কাছ থেকে নূর গ্রহণ করার চেষ্টা চালাবে যাতে এই নূরের আলোতে জান্নাতের পথ ধরতে পারে। কিন্তু তাদেরকে নেতিবাচক জবাব দেওয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা পেছনে ফিরে গিয়ে নূরের সন্ধান করো। অর্থাৎ তোমরা যখন পৃথিবীতে ছিলে এবং পৃথিবীর একটি জীবন পেয়েছিলে সেখান থেকে তোমাদের নূর সংগ্রহ করে আনা উচিত ছিল। কারণ আজকের কিয়ামতের ময়দান প্রতিদান পাওয়ার স্থান, সৎকর্ম করে নূর সংগ্রহ করার স্থান নয়।

ঠিক এ সময় এই দুই দলের মাঝখানে হঠাৎ একটি প্রাচীর স্থাপিত হবে। প্রাচীরের মাঝখানে থাকবে একটি দরজা। কিন্তু দরজার উভয় পাশের পরিবেশ থাকবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর ভিতরের অংশে থাকবে রহমত এবং বাইরের অংশে থাকবে আজাব।  যাই হোক, মানুষ পার্থিব জীবনে যেসব কাজ করবে সেদিন তা প্রতিদান আকারে ধরা দেবে এবং মানুষ জান্নাতি হবে নাকি জাহান্নামি হবে তার ফয়সালা হয়ে যাবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- নৈতিক ও আত্মিক পূর্ণতা অর্জন কিংবা কুফরি ও নিফাকের মতো চারিত্রিক স্খলনের দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

২- কিয়ামতের দিন ঈমানের নূর মানুষের চোখে ধরা দেবে এবং তাদেরকে চিরকালীন জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে।

৩-  পার্থিব জীবনে যারা অজ্ঞতা, শিরক ও নিফাকের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবে কিয়ামতের দিনও তারা অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকবে।

৪- পার্থিব জীবনে মুমিন ও মুনাফিক সহাবস্থান করে এবং পরস্পরকে আলাদা করার উপায় নেই। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে।

এবারে সূরা হাদিদের ১৪ ও ১৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

يُنَادُونَهُمْ أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ قَالُوا بَلَى وَلَكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ وَتَرَبَّصْتُمْ وَارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الْأَمَانِيُّ حَتَّى جَاءَ أَمْرُ اللَّهِ وَغَرَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ (14) فَالْيَوْمَ لَا يُؤْخَذُ مِنْكُمْ فِدْيَةٌ وَلَا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مَأْوَاكُمُ النَّارُ هِيَ مَوْلَاكُمْ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ (15)

“[মুনাফিকরা মুমিনদেরকে ডেকে] জিজ্ঞেস করবে, [পৃথিবীতে] আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না? তারা বলবে, হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিপদগ্ৰস্ত করেছ। আর তোমরা [আমাদের জন্য বিপদের] প্ৰতীক্ষা করেছিলে, [সত্য দ্বীনের প্রতি] সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং [অলীক] আকাঙ্ক্ষা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, অবশেষে [তোমাদের মৃত্যুর ব্যাপারে] আল্লাহর হুকুম আসল। আর মহাপ্ৰতারক [শয়তান] তোমাদেরকে প্ৰতারিত করেছিল আল্লাহ সম্পর্কে।” (৫৭:১৪)

“সুতরাং আজ তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা কুফরী করেছিল তাদের কাছ থেকেও নয়। জাহান্নামই তোমাদের আবাসস্থল। এটাই তোমাদের যোগ্য; আর কত নিকৃষ্ট এ প্রত্যাবর্তনস্থল!” (৫৭:১৫)

মুনাফিকরা বলবে, পৃথিবীতে আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না? তাহলে এখন কী হলো যে, তোমরা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছো? এর উত্তরে মুমিন ব্যক্তিরা বলবেন: হ্যা, আমরা মাঠে, ঘাটে, বাজারে, অলিতে, গলিতে সর্বত্র তোমাদের সঙ্গে ছিলাম কিন্তু তোমরা নিজেদের পথ আমাদের থেকে আলাদা করে নিয়েছিলে। বিশ্বাস এবং আমলের দিক দিয়ে আমাদের সঙ্গে তোমাদের বিশাল পার্থক্য ছিল।

আয়াতের পরবর্তী অংশে জাহান্নামে যাওয়ার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: প্রথমত, পার্থিব জীবনের নানা অপকর্মে জড়িয়ে নিফাক ও কুফরের দিকে ধাবিত হওয়া।  দ্বিতীয়ত, নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন না করা এবং ঈমানদারদের দুর্বলতা কামনা করা। তৃতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে সারাক্ষণ সংশয় ও সন্দেহ পোষণ করা। চতুর্থত, শয়তানের ধোকায় পড়ে পার্থিব জীবনে সীমাহীন আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা এবং পঞ্চমত, আল্লাহর সামনে দম্ভ ও অহংকার করা। পার্থিব জীবনে টাকা-পয়সা খরচ করে বা পরিচিতজনদের সাহায্যে কিংবা ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেক অপরাধের দণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু পরকালে কোনো মুক্তিপণের বিনিময়েই পার্থিব জীবনের কৃতকর্মের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। দুনিয়ার টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি, পরিচিতজন কেউই কিয়ামতের ময়দানে কাজে আসবে না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- পৃথিবীতে মানুষ বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে একসঙ্গে জীবন কাটালেও কিয়ামতের দিন বিশ্বাস ও কর্মের ভিত্তিতে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

২- দুনিয়ার ধোকায় পড়ে দুষ্প্রাপ্য আশা-আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটলে আল্লাহ ও পরকাল সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ ও অহংকার সৃষ্টি হয়।

৩- যে ব্যক্তি আল্লাহর অভিভাবকত্ব বাদ দিয়ে শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তার পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া আর কিছু নয়।

 

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ