জুন ০৮, ২০২৩ ১৫:৫১ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।  আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাদিদের ২০ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ২১ থেকে ২৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই ২১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (21)

“তোমরা অগ্রণী হও তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের প্রয়াসে, যা প্রশস্ততায় আসমান ও যমীনের প্রশস্ততার মত, যা প্ৰস্তুত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনে। এটা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তিনি এটা দান করেন; আর আল্লাহ্‌ মহা অনুগ্রহশীল।”( ৫৭:২১)

আগের আয়াতগুলোতে পার্থিব জীবনের নানা ভোগসামগ্রী ও মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: ঈমানদার মানুষেরা পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তুসমূহকে পরকালে চিরকালীন জান্নাতে যাওয়ার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ যেমন সম্পদ ও ক্ষমতা লাভের জন্য পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তেমনি মুমিন ব্যক্তিরা নেক কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করেন। তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নেক আমল করার মাধ্যমে নিজেদের দিকে আল্লাহর অনুগ্রহ আকর্ষণ করেন। তারা আল্লাহর প্রতিদান লাভ করেন এবং তাদের গুনাহও ক্ষমা করে দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনেরই অন্যত্র বলা হয়েছে, নেক আমলে গুনাহ মাফ হয় এবং আমরা যত বেশি নেক আমল করব তত বেশি আমাদের গুনাহ মাফ হতে থাকবে।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে যে জান্নাতের দিকে আহ্বান করছেন তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যেমন আমাদের সামনে পরিষ্কার নয় তেমনি তার প্রশস্ততা উপলব্ধি করাও আমাদের সাধ্যের বাইরে। সে কারণে, আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের প্রশস্ততাকে আসমান ও জমিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রযুক্তির এত উৎকর্ষের যুগে আজও আসমানের শুরু, শেষ ও এর প্রশস্ততা সম্পর্কে ধারনা লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

আয়াতের পরবর্তী অংশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: জান্নাতের অসীম নেয়ামতের তুলনায় আমরা যে নেক আমল করি তা অতি নগন্য। কিন্তু এই সামান্য নেকির বিনিময়ে আল্লাহ শুধুমাত্র তাঁর অনুগ্রহের কারণে নিজ বান্দাদেরকে জান্নাত দান করবেন। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ আমাদের সৎকাজের সওয়াব ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেবেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যে পৃথিবী দুনিয়াপূজারিদের জন্য দম্ভ ও অহংকার প্রদর্শনের স্থান সেই পৃথিবীকেই ঈমানদার মানুষেরা আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত লাভের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে।

২- দুনিয়াপূজারিরা সম্পদ ও ক্ষমতা লাভের জন্য পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেও ঈমানদার ব্যক্তিরা সৎ কাজ ও নেক আমল করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে।

৩- দু’টি কারণে ঈমানদার মানুষেরা জান্নাত লাভ করবেন। এর একটি হলো আল্লাহর মাগফেরাত যার কারণে তিনি মানুষকে ক্ষমা করে দেবেন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাঁর অনুগ্রহ যার কারণে তিনি মানুষের নেক আমলগুলোকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে তার প্রতিদান দেবেন।

সূরা হাদিদের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ (22) لِكَيْ لَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آَتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (23)

“তোমাদের উপর যমীনে [প্রাকৃতিক বিপর্যয়] বা ব্যক্তিগতভাবে [রোগব্যাধির মতো] যে বিপৰ্যয়ই আসে তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমি তা কিতাবে লিপিবদ্ধ রেখেছি। নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষে এটা খুব সহজ।” ( ৫৭:২২)

“এটা এ জন্যে যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য উল্লাস না করো।  নিশ্চয় আল্লাহ উদ্ধত অহংকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” ( ৫৭:২৩)

মানুষের জন্য যেসব বিপর্যয় আসে তা দুই ধরনের। এক ধরনের বিপর্যয়ে মানুষের কোনো হাত থাকে না। যেমন- বন্যা, ভূমিকম্প, খরা, দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি, মহামারি ইত্যাদি। এসব বিষয় আল্লাহ তায়ালা ঐশী কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। দ্বিতীয় ধরনের বিপর্যয় আসে মানুষের কর্মফলের কারণে। যেমন কেউ যদি ধুমপান কিংবা মাদক সেবনের কারণে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং মৃত্যুবরণ করে সে দায় তার নিজের। সূরা শুরার ৩০ নম্বর আয়াতে এই দ্বিতীয় ধরনের বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে: তোমাদের প্রতি যত বিপদ-আপদ আসে তা তোমাদেরই কর্মফল। আর আল্লাহ তো অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

কাজেই এটা স্পষ্ট যে, যে বিপর্যয়ে আমাদের হাত নেই সে বিপর্যয়ের জন্য আমাদেরকে জবাবদিহী করতে না হলেও যে বিপর্যয় আমাদের কর্মফলে হয় তার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে সৃষ্ট বিপর্যয় সম্পর্কে মানুষের ধারনা যদি স্পষ্ট থাকে তাহলে তারা কোনো বিপর্যয়েই ভেঙে পড়বে না। যদি কোনো কারণে সন্তান মারা যায় তাহলে কুফরি কথা বলবে না এবং যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি ভেঙে যায় তাহলেও হতাশ হবে না। এর বিপরীতে তাদের যদি অর্থ-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ হয় সেজন্যও আনন্দে আত্মহারা হয়ে উল্লাস করবে না এবং মানুষের সামনে দম্ভ ও অহংকার করবে না।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- ভূপৃষ্ঠে এবং ব্যক্তিগতভাবে যত বিপর্যয় ঘটে তা ঐশী কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসব বিপর্যয় দৈবক্রমে কিংবা আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ঘটে না।

২- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসহীন মানুষই কেবল কঠিন পরিস্থিতিতে হতাশ এবং সুখের দিনে উল্লাস ও অহংকার করে। পক্ষান্তরে ঈমানদার মানুষ কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ এবং সুখের দিনে আল্লাহর শোকর আদায় করে।

৩- স্বাভাবিক আনন্দ প্রকাশ কিংবা দুঃখ পাওয়া দোষণীয় কিছু নয় কিন্তু অতীত নিয়ে অযথা অনুশোচনা করা অথবা যা আছে তা নিয়ে উল্লাস ও অহংকার করা গুনাহের কাজ।

এবারে সূরা হাদিদের ২৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَمَنْ يَتَوَلَّ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (24)

“যারা কার্পণ্য করে ও মানুষকে কার্পণ্যের নির্দেশ দেয় এবং যে [দান করা ও ঋণ দেয়া থেকে] মুখ ফিরিয়ে নেয় [সে জেনে রাখুক] নিশ্চয় আল্লাহ্ অভাবমুক্ত, চির প্রশংসিত।” ( ৫৭:২৪)

আগের আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যারা চরম ভোগ বিলাস করে এবং দম্ভভরে চলাফেরা করে আল্লাহ তায়ালা তাদের পছন্দ করেন না। এ ধরনের মানুষের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: যদিও আল্লাহ তাদেরকে প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী করেছেন কিন্তু তারা সেই সম্পদের ক্ষুদ্র একটি অংশও দান করতে বা ঋণ দিতে রাজি নয়। তারা স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রীক এবং পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ তাদের হস্তগত হলেও তাদের এই আচরণে পরিবর্তন আসবে না।

কৃপণ মানুষ মনে করে তাদের হাতে যে সম্পদ রয়েছে তার মাধ্যমেই তারা বড় ও সম্মানজনক মানুষ হতে পেরেছে। কাজেই অন্যদের চেয়ে বড় হওয়ার এই উপকরণ তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো এ ধরনের দুনিয়াপ্রেমী মানুষ ভাবে সে যেটা করছে এটাই সঠিক পথ। এ কারণে তারা অন্যদেরকেও একই কাজ করার নির্দেশনা দেয়। তারা মানুষকে তাদের সম্পদ দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিদের দিতে নিষেধ করে এবং তাদেরকে কৃপণ হওয়ার উপদেশ দেয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- নিজে কৃপণ হওয়ার চেয়েও বড় অপরাধ হলো অন্যকে কার্পণ্য করতে উৎসাহিত করা। এ কারণে নবী-রাসুলগণ কৃপণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে এবং তাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।

২- ধন-সম্পদ অর্জন করার পর তা থেকে কতটা দ্বীনের রাস্তায় খরচ করছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে বহু সম্পদশালী মানুষ আছে যারা কৃপণ আবার অনেক দরিদ্র মানুষ আছে যারা উদারহস্ত।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  #

 

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।