জুন ১০, ২০২৩ ২০:৪৯ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা রসায়ন শাস্ত্রের উৎপত্তি ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে আমরা আলকেমি ও রসায়ন শাস্ত্রের পাথর্ক্য সম্পর্কে জেনেছি।

খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে ইরানের বিভিন্ন টিলা থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন থেকে সে যুগে রসায়নের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ইরানের ইতিহাস বহু প্রাচীন। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগে ইরানে রসায়ন শাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল এবং বহু মুসলিম মনীষীর আবির্ভব ঘটেছিল। এমনই একজন মনীষী ছিলেন আবু বকর মুহাম্মাদ বিন যাকারিয়া রাযি ছিলেন একজন নামকরা চিকিৎসাবিদ। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা যাকারিয়া রাযির জীবনী ও বিভিন্ন গবেষণাকর্ম নিয়ে আলোচনা করবো। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।     

হিজরী ২৫১ সালের পহেলা শাবানে আবু বকর মুহাম্মাদ বিন যাকারিয়া রাযি বর্তমান তেহরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। রাযির জন্মের সময় রেই ছিল খুবই উন্নত একটি এলাকা এবং ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। রাযি রেই'তে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়েন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ছাড়াও রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়েছেন।

উয়ুনুল আম্বিয়া গ্রন্থে ইবনে উসাইবার বর্ণনা অনুযায়ী রাযি যখন বাগদাদে এসছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞানপিয়াসী। বিশেষ করে সাহিত্য এবং দর্শনের ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। বেশি বয়সে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়েন। তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন আলী বিন রাবান তাবারি। রাযি যখন বাগদাদ থেকে রেই শহরে ফিরে আসেন তখন এখানকার একটি হাসপাতালের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে চিকিৎসার কাজ ছাড়াও যারা চিকিৎসাবিদ্যার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন তাদেরকে এই বিদ্যা শেখাতেন।

আলহিকমার ইতিহাস গ্রন্থে এসেছে, 'মুসলিম বিজ্ঞানী এবং হাসপাতালের ডাক্তার রাযি প্রথমে রেই হাসপাতালের দায়িত্ব নেন এবং তারপর বাগদাদ হাসপাতালের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাযিকে অনেকেই ইসলামি জালিনূস নামে অভিহিত করতো'।

ইবনে সিনার পর ইসলামি সভ্যতার যুগের সবচেয়ে বড়ো চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর ছাত্র এবং রোগীদেরকে ভালোবাসতেন এবং সবসময় লেখালেখি করতেন বা পড়ালেখা করতেন যতোদিন না তিনি অন্ধত্ব বরণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রাযি যেসব গবেষণা করেছেন সেগুলো ছিল তাঁর চোখে দেখা অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে করা গবেষণা।

ইতিহাসে এসেছে, যখন ইজদুদদৌলা দেইলামি চেয়েছিলেন বাগদাদে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে তখন বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই রাযিকে বলেছিলেন হাসপাতাল তৈরি করার জন্যে সবোর্ত্তম এবং উপযুক্ত একটি স্থান নার্বাচন করতে।  রাযি যেহেতু এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন সেজন্যে তিনি মজার একটা কাজ করলেন। তিনি তাঁর সহযোগীদের বললেন, শহরের বিভিন্ন স্থানে গোশতের টুকরো ঝুলিয়ে রাখতে। তাই করা হলো। চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে ঝুলে থাকার পর তিনি একটার সাথে আরেকটাকে তুলনা করলেন। তারপর আদেশ দিলেন যে স্থানের গোশতের টুকরা তুলনামূলকভাবে ভালো সেখানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে।

যাকারিয়া রাযি

রাযি ছিলেন নতুন নতুন জিনিসের উদ্ভাবক। বিনা গবেষণায় তিনি তাঁর পূর্ববর্তী চিকিৎসাবিদদের ধারণা বা ব্যবস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করতেন না।

‘আশশুকুকু আলা জালিনূস' নামে তাঁ একটি গ্রন্থ রয়েছে। তাতে তিনি জালিনুসের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করেছেন। আলোক রশ্মি এবং দেখা ও শোনার ব্যাপারে জালিনুসের দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করেছেন সবচেয়ে বেশি। রাযি জালিনুসের বিপরীত মত দিয়েছেন এ সম্পর্কে।

যাকারিয়া রাযি ছোটো বড়ো মিলিয়ে অন্তত দুই শ'টি বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১০০টি বই লিখেছেন চিকিৎসা, ফার্মাসি বা ঔষধ বিজ্ঞান, দর্শন, প্রকৃতি বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের ওপর। বিশেষ করে 'আলহাভি' এবং 'আলমানসুরি' গ্রন্থদু'টি চিকিৎসা বিষয়ে লেখা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর অন্যতম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুটি মৌলিক গ্রন্থ এগুলো। আলহাভি গ্রন্থে রাযি শয্যাশায়ী রোগীদের ব্যাপারে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। গুরুত্বের দিক থেকে এই গ্রন্থটিকে চিকিৎসা-বিশ্বকোষ হিসেবে মনে করা হয়। এখনো এই গ্রন্থটির মূল আরবি সংস্করণের অন্তত অর্ধেকটার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। রাযির হাভি গ্রন্থটির দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি হলো ব্যবহারিক বিভাগ অপরটি তাত্ত্বিক বিভাগ। ইসলামি যুগের মাঝামাঝি সময়ে চিকিৎসা বিষয়ক অপরাপর লেখালেখির জন্যে এই দুটি বিভাগ ছিল উপযুক্ত আদর্শ।

আলহাভিতে বারোটি অধ্যায় রয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়েই রয়েছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংলিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আলেোচনা। এ বইতে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ভেষজ ওষুধ তৈরি ও পরিচিতিসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে।     

চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রাযির অপর একটি বই হচ্ছে আলমানসুরি। এই বইটি সর্বপ্রথম কোনো বই যা ইউরোপে ছাপা হয়েছিল। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ঔষধপত্র, কীটপতঙ্গের বিষ, জখমসহ আরো বহু বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে এ বইটিতে। ল্যাটিন ভাষায় বইটির বহু সংস্করণ ছাপা হয়েছে। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে এ বইটি ইতালিয় ভাষাতেও অনূদিত এবং মুদ্রিত হয়। বসন্ত এবং হাম সম্পর্কেও তাঁর একটি মূল্যবান বই আছে। বইটির নাম হচ্ছে 'আলজাদরি ওয়াল হাসবা'। বসন্ত নিয়ে বা হাম নিয়ে সম্ভবত প্রাচীনতম বই এটি।

রাযিই সর্বপ্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানী যিনি হাম থেকে বসন্তকে আলাদা করেছেন এবং পৃথক দুটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই বইটি পশ্চিমাদের চক্ষুকে ছানাবড়া করে দিয়েছে এবং চিকিৎসা বিষয়ক বই পুস্তকের মাঝে এ বইটিকে তারা প্রাচীন চিকিৎসা বিষয়ক একটি উত্তম বই বলে উল্লেখ করেছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হিসেবে এ বইটিকে স্মরণ করা হয়।

হাম এবং বসন্ত নিয়ে রাযি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এই রোগ দু'টির যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, তা অনেকটাই এসব রোগের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির কাছাকাছি। চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস লেখক নেভিবুর্গারসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করছেন মোটামুটি তাদের সবাই রাযির এই গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করেছেন। কেবল উল্লেখই নয় বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের ক্ষেত্রে এই বইটির গুরুত্ব অপরিসীম বলেও মন্তব্য করতে ভোলেননি তাঁরা। ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই বইটির অন্তত চল্লিশটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

মূত্রথলির পাথর এবং কিডনির পাথর নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা চালিয়েছেন এবং তাঁর ঐসব গবেষণা একটি বইতে সংকলিত হয়েছে। মূল আরবি ভাষার ঐ সংকলনটি ফরাশি ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও হয়েছে। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বইটি লন্ডনেও ছাপা হয়। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ