জুন ১৮, ২০২৩ ২১:৫৯ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের খ্যাতনামা মনীষী ইবনে সিনার জীবনী ও তার গবেষণাকর্মের কিছু দিকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দয়েছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন বিখ্যাত মনীষী ও বিজ্ঞানী জাবের ইবনে হাইয়্যানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।

অতীতে বিজ্ঞানের একটি শাখা ছিল রসায়ন। তবে রসায়নবিদ্যাকে প্রাচীনকালের লোকজন মনে করতো কারিগরী এবং যাদুর সংমিশ্রিত একটি জ্ঞান। ধীরে ধীরে এই বিদ্যাটির ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আসে এবং আজকের রসায়নবিদ্যার রূপ ধারণ করে। রসায়নে সাধারণত ধাতব এবং খনিজ পদার্থ ব্যবহার করা হতো। মনে করা হতো প্রকৃতিতে যে কোনো বস্তুরই ভূমিকা রয়েছে। সেজন্যে রসায়নবিদগণ প্রকৃতির বিচিত্র বস্তুর পরিচিতির জন্যে জ্যোতিষ চিহ্ন ব্যবহার করতেন। যেমন স্বর্ণকে তাঁরা সূর্যের চিহ্ন দিয়ে বোঝাতেন। রূপাকে বোঝাতেন চাদেঁর চিহ্ন দিয়ে। পারদকে বোঝানো হতো মার্কারি চিহ্ন দিয়ে। তামার চিহ্ন ছিল ভেনাস।

অবশ্য একদল রসায়নবিদও ছিলেন যারা আত্মার রসায়নের দিকেও মনোযোগ দিতেন। অর্থাৎ তাঁরা চাইতেন তামাকে খাটিঁ সোনায় রূপান্তর করতে। এ রূপক কথাটির মানে হলো তাঁরা চাইতেন আত্মার উন্নয়ন ঘটিয়ে উন্নত মানবীয় স্তরে পৌঁছতে।

এ আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই অনুমান করা যায় যে, প্রাচীনকালে রসায়ন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা ছিল যেখানে প্রাকৃতিক বিষয় ছাড়াও আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও চর্চা করা হতো। রসায়নের উপকরণ উপাদানের মধ্যে তখন অন্তর্ভুক্ত ছিল ধাতব কাজ, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, আধ্যাত্মিক বিদ্যা এবং আত্মা বা রূহের জগতের প্রতি বিশ্বাসসহ আরো বহু বিষয়।

রসায়নবিদদের মতে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সকল অবদান যেমন খনি, ধাতব বস্তু সামগ্রী ইত্যাদি খুবই পবিত্র জিনিস। আর রসায়নবিদ্যর কাজ হলো পবিত্র এই বস্তুগুলো নিয়ে গবেষণা করা এবং সেগুলোর ব্যাপারে সঠিক ধারণা দেওয়া। রসায়নবিদগণ তখন একসির নামে এমন একটি পদার্থের খোজেঁ ছিলেন যা দিয়ে তাঁরা লোহা এবং তামার মতো ধাতব বস্তুকে স্বর্ণে পরিণত করতেন। এই রসায়নবিদ্যাটি নির্দিষ্ট একটি বিদ্যা হিসেবে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা পায় পশ্চিম ভূখণ্ড এবং মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায়।

রসায়নবিদ্যা সম্পর্কে বলা যায় মুসলমান বিজ্ঞানীগণ এই বিদ্যার উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ঐতিহাসিক যেসব তথ্যপঞ্জী রয়েছে তা থেকে যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা যায় তাহলো আধুনিক যে রসায়ন বা কেমিস্ট্রি আমরা বর্তমানে বিদ্যার একটি শাখা হিসেবে পাচ্ছি, তার প্রতিষ্ঠা এবং বিকাশ ঘটে আনুমানিক বারো শ'বছর আগে ইসলামের আবির্ভাবের পর। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে মুসলমান মনীষীগণই এই শাস্ত্রের গোড়াপত্তন করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীগণ রসায়নের প্রত্যেকটি শাখা নিয়েই গবেষণায় লিপ্ত হয়েছিলেন।

অনেক মুসলিম রসায়নবিদ রসায়নবিদ্যার অভ্যন্তরে পরিবর্তনও এনেছেন। অনেকে আবার বস্তুর রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়েও গবেষণা করেন। এদের কয়েকজনের মধ্যে আবুল কাসেম মুহাম্মাদ ইরাকি, যাকারিয়া রাযি এবং জাবের ইবনে হাইয়্যান তূসির নাম উল্লেখ করা যায়। এদেঁর সবাই রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পৃথক পৃথক গবেষণা চালিয়েছেন।

জাবের ইবনে হাইয়্যান তূসি

মুসলমান রসায়নবিদদের মধ্যে জাবের ইবনে হাইয়্যান তূসির নাম বহুল পরিচিত। জাবের ইবনে হাইয়্যানের পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান।

রসায়নের ওপর সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁরই। কেবল মুসলিম ভূখণ্ডেই নয় বরং পশ্চিমা বিশ্বেও রসায়নের ব্যাপারে তাঁর সর্বাধিক অবদানের বিষয়টি স্বীকৃত। জাবের ইবনে হাইয়্যান ছিলেন একজন ইরানী মনীষী। তিনি খোরাসান প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক (আ) এর সুযোগ্য এবং অনেক বড়ো মাপের একজন ছাত্র। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল ইমাম জাফর সাদেক (আ) এর কাছ থেকে অর্জিত সামগ্রিক জ্ঞান। ইবনে খাল্লাকন ইমাম জাফর সাদেক (আ) এর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, তাঁর ছাত্র আবু মূসা জাবের ইবনে হাইয়্যান এমন এক বই লিখেছেন যার মাঝে তাঁর অন্তত পঞ্চাশটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জাবের ইবনে হাইয়্যানের দৃষ্টিতে খনিজ দ্রব্যের বিশেষ গুরুত্ব ছিল এবং ধাতুর রূপান্তরের মতো আবিষ্কারগুলো এমনকি তিনি স্বর্ণের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতেন। জাবের ইবনে হাইয়্যানের আবির্ভাবের ফলে রসায়ন মুসলমানদের কাছে ল্যাবরেটরির ব্যবহারিক একটি জ্ঞান হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। 

জাবের ছিলেন রসায়নের গুরু। তিনি বিভিন্ন ধরনের খনিজ পাথরকে রূপান্তরের কাজে গবেষণা চালাতেন। তিনি তামা, শিসার মতো ধাতব বস্তুর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা এবং কীভাবে সেগুলোকে মূল্যবান ধাতুতে পরিবর্তন বা রূপান্তর করা যায় সে সম্পর্কে অনেক বই পুস্তক লিখেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম আয়রন সালফেট থেকে সালফিউরিক এসিড তৈরি করেছিলেন। জাবের পানি, তেল এবং নির্যাসের মতো তরল পদার্থকে পরিশুদ্ধ করতেন। জাবের ইবনে হাইয়্যানের দৃষ্টিতে স্বর্ণকে কয়েকটি পর্বে ফোটানোর মধ্য দিয়ে এক্সির পাওয়া সম্ভব। তিনি সস্তা মূল্যের ধাতব বস্তুকে মূল্যবান ধাতুতে রূপান্তর করার জন্যে এক্সির তৈরিতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

জাবের ইবনে হাইয়্যান তূসি রসায়নবিদ্যা সম্পর্কে মূল্যবান বহু সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন। গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং পুস্তিকা মিলিয়ে তিনি তিন হাজারের মতো সৃষ্টিকর্ম পরবর্তীকালের পাঠক এবং গবেষকদের জন্যে রেখে যান।

জাবেরের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গবেষণা করেছিলেন জার্মানির বিশিষ্ট গবেষক ও বিজ্ঞানী পাওয়েল ক্রাউস। তিনি জাবেরের লেখালেখি সম্পর্কে বলেছেন, 'জাবের এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে আরবিতে লিখে গেছেন। তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং প্রতিভা ছিলেন। অনেক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। এমনকি গ্রিক সাহিত্য সম্পর্কেও তিনি যথার্থ জ্ঞান রাখতেন। তিনিই বিজ্ঞান সংক্রান্ত পরিভাষার যথাযথ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছিলেন। হিজরী তৃতীয় শতকের অনুবাদকদের জন্যে তিনি এসব পরিভাষা অনুবাদ করেছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। আর এই পরিভাষা অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে তিনি সে সময়কার অনুবাদকদের পথ সুগম করে গিয়েছিলেন।'

তাঁর অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে জাবেরি সংকলন নামক যে বইটি রয়েছে, ঐ বইটিতে মোটামুটি বিশ্ব সম্পর্কে জানা, জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়ম কানুন, রসায়ন ইত্যাদি থেকে শুরু করে মিউজিক, হিসাব বিজ্ঞান এবং বর্ণ পর্যন্ত প্রায় সকল বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করার জন্যে কিংবা সেগুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্যে এসব আলোচনা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান  হোসেন/১৮

 

 

ট্যাগ