জুলাই ০৪, ২০২৩ ১৮:৫৭ Asia/Dhaka

গত আলোচনায় আমরা জীববিজ্ঞানে প্রাচীন ইরানিদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ভাষাবিজ্ঞানের গুরুত্ব এবং এ ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বিজ্ঞানের উৎস হচ্ছে ভাষা এবং জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ভাষার মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা হয়। ভাষাবিজ্ঞান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এমন একটি অধ্যায় যেখানে অনেক আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। চিন্তাবিদ ও গবেষকদেরকে বিজ্ঞানের সকল শাখায় বিশেষ করে হিউম্যানিটিজ বা মানবিক শাখার নানা দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরতে গেলে ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের খুব ভালো ধারণা থাকতে হবে। কেননা, ভাষাবিজ্ঞান হল বৈজ্ঞানিক উপায়ে কোনো ভাষা সম্পর্কে গবেষণা ও অধ্যয়ন করার বিজ্ঞান। ভাষাতত্ত্বকে ভাষা বর্ণনার বৈজ্ঞানিক মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা যায়। ভাষাবিজ্ঞানে ভাষাকে দু'দিক থেকে মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ করা যায়।   

একদিকে, ভাব বিনিময়ের জন্য ভাষার যে বিচিত্র ব্যবহার রয়েছে এবং যে কারণে মানুষ গবেষণা করতে পারে সে জন্য মানুষ পশুদের থেকে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। অন্যদিকে, মাতৃভাষাসহ বিশ্বের সমস্ত ভাষার ওপর গভীরভাবে গবেষণা চালানো যায়।

ভাষার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে মানুষ জাতি একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এটা মনে রাখা দরকার যে, মানব সমাজ কখনই স্থির থাকে না এবং ক্রমাগত পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। এ কারণে দেখা যায় ভাষাও সামাজিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। যে বিশেষ আইনের উপর ভিত্তি করে ভাষায় পরিবর্তন ঘটে সেই আইনের ওপর গবেষণা করে ভাষার পরিবর্তনের বিষয়টি চিহ্নিত করা ভাষাবিজ্ঞানের কাজের অন্তর্ভুক্ত। ভাষাতত্ত্ব এমন একটি বিজ্ঞান যার সাহায্যে ভাষার পদ্ধতিগত অধ্যয়ন এবং গবেষণা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, ভাষা এবং ভাষাতত্ত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। উদাহরণ স্বরূপ, "ভাষা কি?", "ভাষা কীভাবে কাজ করে এবং এর গঠনপ্রকৃতি কী?", "মানুষ কীভাবে ভাষার মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে?", "একটি শিশু কীভাবে কথা বলতে শেখে?", "মানুষের ভাষা কীভাবে বিবর্তিত হয়?", "বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার অভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী? এবং "কেন কোনো কোনো ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়?"।

প্রায় ১০০ বছর আগে ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান নতুন অর্থে ও একটি অপেক্ষাকৃত নতুন বিজ্ঞান হিসেবে আমাদের সামনে এসেছে। কিন্তু ভাষা নিয়ে গবেষণাকর্ম খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত ভাষাবিদ ও সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনি'র কথা উল্লেখ করা যায়। 'অষ্টাধ্যায়ী' নামে একটি সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের জন্য তিনি বিখ্যাত।

ভাষা একটি জটিল মানবিয় ও সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে মিশে আছে। ভাষার বর্ণনামূলক এবং তাত্ত্বিক দিকগুলো অধ্যয়ন করার পাশাপাশি ভাষাবিজ্ঞান মনস্তাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, শৈল্পিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং ভাষার সেমিওটিক্স বা সাংকেতিক বিজ্ঞানের দিকগুলোর প্রতিও নজর দেয়। অন্যকথায় বলা যায়, গবেষণার  জন্য বর্তমান যুগে ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্র এতোটা বিশাল ও বিস্তৃতি লাভ করেছে যা কিনা জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পণ্ডিত ও গবেষকদেরকে আকৃষ্ট করেছে।

ভাষা ও চিন্তাভাবনা, ভাষা ও পরিচিতি, ভাষা ও দার্শনিক পদ্ধতির মধ্যে সম্পর্ক, ভাষা ও যুক্তি, ভাষা ও আইন, ভাষা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতি, ভাষা ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কের মতো বিষয়গুলোসহ আরো অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষার গুরুত্ব প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যয়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যে ব্যক্তি ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন তাকে ভাষাবিদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অনেকে মনে করেন ভাষাবিদ হতে হলে অনেকগুলো ভাষা জানতে হবে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একজন ভাষাবিদদের জন্য একাধিক ভাষা আয়ত্ত করার প্রয়োজন হয় না। বরং এ ক্ষেত্রে একটি ভাষার ওয়ার্ড বা শব্দ, অক্ষর বা সিলেবল, সিনট্যাকটিক গ্রুপ, অর্থ ও সংলাপের বিষয় অন্বেষণ করা জরুরি।

নোয়াম চমস্কি

বর্তমান যুগের বিখ্যাত ভাষাবিদ  হলেন নোয়াম চমস্কি। বলা যায় তিনি এ ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, 'ভাষার নিয়ম ও বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে সহজাত ও উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। শিশুর চারপাশের পরিবেশ মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করে। শিশু তার মাতৃভাষায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে প্রাথমিক ও সীমিত পর্যায়ে তথ্য বা জ্ঞান আহরণ করে এবং পরবর্তীতে সে নিজেই নতুন তথ্যের ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়'।

বিভিন্ন জাতি ও জাতিসত্তার ইতিহাসের দিকে তাকালে সেইসব জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে লেখাজোকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। আজ যদি ইরানিরা তাদের অতীত শক্তিশালী সভ্যতার জন্য গর্বিত হয় তাহলে এর মূল কারণ হল অতীতের লিখিত রচনাসামগ্রী যা তাদের ঐতিহ্যকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। ভাষাগত ও লিখন পদ্ধতিতে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে প্রাচীন পারস্য ও বর্তমান ইরানিদের সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে  ইরানি ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ, অক্ষর ও লিখন পদ্ধতি সৃষ্টির ইতিহাস অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইরানে ভাষাবিজ্ঞানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন ইরানের আবেস্তা ও পাহলভি পাঠ্য লেখার জন্য বিভিন্ন লিপি উদ্ভাবন কিংবা এই ভাষার পাঠ্য সম্পর্কিত অভিধান সংকলন ও ব্যবহার দুই হাজার বছরেরও বেশি আগের। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ভাষার ওপর গবেষণায় ইরানিদের অবদানও ছিল নজর কাড়ার মতো। ভাষার ব্যাকরণ, বাক্য গঠন এবং শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে বড়  বড়  পণ্ডিতরা অনেক বড় অবদান রেখেছেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ভাষাবিদ্যা শিক্ষার কেন্দ্রগুলো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের কাছে ঋণী ছিল। অন্যভাবে বলা যায়, ভাষাতত্ত্বের শেকড় নিহিত ছিল ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে। এসব কেন্দ্রে শুদ্ধভাবে ভাষা শিক্ষা ও ব্যাকরণ অধ্যয়নের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হতো। এক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রচুর আগ্রহ ও ধর্মীয় উদ্দীপনা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। দুটি কারণে নির্ভুলভাবে ভাষা শিক্ষা ও  গবেষণায় মুসলমানদের আগ্রহ ছিল। প্রথমত, ভুল পাঠের কারণে কুরআনের আয়াতগুলোকে বিকৃতির ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য মুসলমানরা ভাষাগত অধ্যয়ন, ধ্বনিতত্ত্ব এবং ব্যাকরণের দিকে ঝুঁকেছিল। আর দ্বিতীয় কারণ ছিল আয়াতগুলোর সঠিক অর্থ বোঝার চেষ্টা করা। 

পরবর্তীতে মুসলমানদের মধ্যে যারা অনারব ছিল তাদের আরবি ভাষা এবং আরবি ভাষার বাকপটু রূপ বা কথা বলার ধরন শিখতে হয়েছিল। সে সময় কোরানের ভাষা শেখার এবং ওহীর উৎস জানার জন্য অমুসলিমরা বিশেষ করে ইরানিরা আরবি ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এ বিষয়টি অন্য মুসলিম ভূখণ্ডে ভাষাতত্ত্বের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ