পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা: (পর্ব-৬)
'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক অনুষ্ঠানের গত পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের চবাহার ও পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর এবং ঐতিহাসিক সিল্করোডের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা 'সাউথ-ইস্ট স্ট্রিং অফ পার্লস' বা ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মুক্তোর ছড়া' নামে সমুদ্রপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ে আলোচনা করব।
গত কয়েকটি পর্বে আমরা চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি'এর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। সিপিইসি'র ভৌগোলিক পরিধি এবং রোডম্যাপ চীনের মুসলিম অধ্যুষিত শিন জিয়াং রাজ্য থেকে শুরু হয়েছে এবং মধ্যএশিয়া, দক্ষিণ ককেশিয় অঞ্চল, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে এ প্রকল্পের সাথে যুক্ত করেছে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ অঞ্চলের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো ও সরকার ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হলেও তা জন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি। এ অঞ্চলের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হওয়ায় বৃহৎ শক্তিগুলোর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। এ কারণে চীন ঐতিহাসিক সিল্করোড পুনরুজ্জীবনের যে বৃহৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছে তার মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রও বিকল্প পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। মধ্যএশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক বাহরাম আমির আহমাদিয়ান বলেছেন, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চীনের বিকল্প নতুন এমন এক সিল্করোড পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছিলেন যাতে ইরান, চীন ও রাশিয়া কোনো সুবিধা নিতে না পারে।
আমেরিকার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীনের বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত এলাকায় নিজেদের প্রভাব জোরদার করা। কিন্তু চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' বাস্তবায়ন, ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি সই এবং ইরান, চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী 'ওয়াখান করিডোর' প্রকল্প বাস্তবায়ন আর্থ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা কিনা আমেরিকার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
বলা যায়, সিল্করোড পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও চীন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যও আলাদা। আমেরিকানদের লক্ষ্য হল এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বলয়কে শক্তিশালী করার জন্য জাতিগত কোন্দল ও বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেয়া। এ দু'টি উপাদান ব্যবহার করে আমেরিকা এই অঞ্চলে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার কৌশল নিয়েছে।
কিন্তু চীনের লক্ষ্য হচ্ছে আর্থ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা যাতে 'ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট' ও ইরান-চীন ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তিসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো যায়।
বাস্তবতা হচ্ছে, চীন, পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তান এই চারটি দেশেই জাতিগত বৈচিত্র্য রয়েছে।
এ অঞ্চলের জনগণ মনে করে আমেরিকা শুধু যে আঞ্চলিক রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে তাই নয় একই সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর অভ্যন্তরে স্থায়ী সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমেরিকা চীনের উইঘোর ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে যাতে এ অঞ্চলের চারটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু এর বিপরীতে এ অঞ্চলের দেশগুলো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের মাধ্যমে আঞ্চলিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে চীনের প্রস্তাবিত বৃহৎ 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনার আওতায় চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' এবং ইরান-চীন ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে সমগ্র এ অঞ্চলের জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন এ দেশগুলোর মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা ছাড়াও 'সাউথ-ইস্ট স্ট্রিং অফ পার্লস' বা ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মুক্তোর ছড়া' নামে সমুদ্রপথে যোগাযোগ ব্যবস্থারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সমুদ্রপথের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো হয়ে মালাকা প্রণালীর মধ্য দিয়ে উত্তর ভারত মহাসাগরের সাথে যুক্ত হবে। এই প্রকল্পের আওতায় বাণিজ্য জাহাজ চীন থেকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা হয়ে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করবে এবং তা ইরানের ম্যাকরন বন্দর ও পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে গিয়ে ভিড়বে।
এ ছাড়া, চীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম চীন থেকে শুরু করে মধ্যএশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশ ও পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপের বাজার অভিমুখে রেল ও সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিল্করোড অঞ্চলে ইরানের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
রেল ও সড়ক যোগাযোগ ছাড়াও আরেকটি বিষয় 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আর সেটা হচ্ছে কাস্পিয়ান সাগর ও পারস্য উপসাগরের জ্বালানী সরবরাহ লাইন গোয়াদর পর্যন্ত স্থাপন করে সেখান থেকে তা চীনে সরবরাহ করা। বলা যায় দীর্ঘ মেয়াদে চীনের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এই সরবরাহ লাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যা কিনা 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প বাস্তবায়নকে আরো সহজ করবে। সুতরাং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই প্রকল্পের আওতায় বাণিজ্য, পণ্য ট্রান্জিট ও জ্বালানি সরবরাহের ফলে এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশ লাভবান হবে। এখন পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের ১০০টির বেশি দেশ 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পে যুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ কারণে ইরান, পাকিস্তান ও চীনের যৌথ প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব অনেক বেড়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ভূমিরা রাখবে। এর ফলে এই অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন বিকল্প অর্থনৈতিক জোট গঠনের নীতি কার্যত ব্যর্থ হতে চলেছে। তাই নিঃসন্দেহে আগামী দশকগুলোতে আমেরিকার পর চীনই হবে বৃহৎ শক্তির দেশ। যদিও আমেরিকা কোনোভাবেই চীনের এ উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।